ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

প্রচণ্ড ইচ্ছের কাছে ধরা দিলো সাফল্য

আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:২৬ পিএম

নেত্রকোনা জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম ঘিড়ুয়ারী। কৃষক আব্দুস ছালাম ও গৃহিণী বিলকিছ দম্পত্তির সন্তান মুজাহেদুল ইসলাম তামিম নিজের মেধা, মনন, পরিশ্রম ও প্রচণ্ড ইচ্ছে শক্তি দিয়ে দেশের তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। বাবা আব্দুস ছালাম কৃষি কাজের পাশাপাশি স্থানীয় একটি মসজিদের ইমামতি করেন।

তামিম ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। বর্তমান রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় ‘হ্যালো কারস’ নামে গাড়ি আমদানিকারক ও বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

তামিম প্রমাণ করেছেন ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’, শৈশবের শতকষ্টের পরও থেমে থাকেননি। ছোট বেলায় মধ্যবিত্ত পরিবারের সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। কখনো বই কেনার টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। কখনো বা জোটেনি টিফিনের পয়সা। তারপরও পড়াশোনার প্রতি আদম্য আগ্রহ ও এবং মায়ের চোখে আশার আলো তাকে এক মুহূর্তের জন্যও থামতে দেয়নি।

২০১১ সালে তিনি নেত্রকোনা কোনাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। ২০১৫ সালে ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে বিশেষ কোর্স ‘বি এস সি ইন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন তিনি। বর্তমানে কর্মজীবনের পাশাপাশি শখের বসে অতীশ দিপংকর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে এল এল বি (অনার্স) দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়ন করছেন। তিনি নিজেকে আরও বহুমাত্রিকভাবে গড়ে তোলার পথচলায় এগিয়ে যাচ্ছেন।

কর্মক্ষেত্রে ছাত্রজীবনেই তিনি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন। তখন বয়স মাত্র কুড়ির কোঠায়ও পৌঁছায়নি। প্রথম মাসে উপার্জন ছিল মাত্র ১৫০০ টাকা। তবে অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে প্রথম আয় করেন ৩৫.০১ মার্কিন ডলার, তৎকালীন বাজারে তা প্রায় ২৬০২ টাকার মতো।

এই টাকাই তার জীবনে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। তার মধ্যে বেড়ে যায় আত্মবিশ্বাস। মনে মনে বললেন, ‘আমিও পারব’। সময়ের ব্যবধানে সেই ক্ষুদ্র আয় আজ বহুগুণে বেড়েছে। এখন তার একদিনের আয় তখনকার কয়েক মাসের সমান।

শিক্ষা জীবনের শেষ দিকে জীবিকার তাগিদে তিনি যোগ দেন শাহীন শিক্ষা পরিবারে। মাত্র ১০ হাজার টাকা বেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু এখানেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. মাসুদুল আমিন শাহীন হয়ে ওঠেন তার জীবনের দিক নির্দেশক।

তামিম বলেন, ছাত্রজীবনে যখন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে ছিলাম, তখন শাহীন স্যার ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। তার কারণেই আমি আমার কর্মজীবনের প্রথম মঞ্চটা পেয়েছি। কর্মদক্ষতা ও সততার কারণে অল্প সময়েই আমাকে হেড অব আইটি পদে উন্নীত করেন তিনি। বেতন বাড়ে ১২ হাজার টাকা। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি।

নিজের দক্ষতা ও নিরলস পরিশ্রমের কারণে তিনি পরবর্তীতে সুযোগ পান শাহীন শিক্ষা পরিবারে অপর একটি প্রতিষ্ঠান ‘হ্যালো কারস’ নামের একটি শীর্ষস্থানীয় গাড়ি বিক্রয় ও সেবাদান প্রতিষ্ঠানে। ধীরে ধীরে সেখানেও নিজের জায়গা তৈরি করে নেন তিনি। আজ তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর জেনারেল।

বর্তমানে হ্যালো কারস শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও স্বীকৃতি পাচ্ছে। সৌদি আরব, ভারত, থাইল্যান্ড ও জাপানসহ চারটি দেশে রয়েছে তামিমের কাজের সংযোগ। তার অধীনে এখন একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন।

তিনি বলেন, চাকরি জীবনের আমি গড়ে তুলেছি বিমান ও হেলিকপ্টার ভাড়া ও টিকেট ক্রয় বিক্রয় প্রতিষ্ঠান ‘তাজওয়ার এয়ারওয়েস’ ও কৃষি ভিত্তিক স্টার্টআপ ট্রাস্ট ফার্মার। যেখানে অনেকে কর্মরত রয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন শাহীন শিক্ষা পরিবার এর চেয়ারম্যান মো. মাসুদুল আমিন শাহীন।

তামিম বলেন, এক সময় ফ্রিল্যান্সিং থেকে শুরু করে আজ এত বড় দায়িত্বে আসাটা সহজ ছিল না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, কাজ আর সততার বিকল্প নেই।

প্রত্যেক সফল মানুষের পিছনে অনুপ্রেরণা দেওয়ার মতো কিছু মানুষ থাকে। যারা নীরবে পথ দেখান। হ্যালো কারস’র চেয়ারম্যান মাসুদুল আমিন শাহীন তামিমের জীবনে এমনই একজন। পাশাপাশি উল্লেখ্যযোগ্য অনুপ্রেরণার উৎস জাকারিয়া মাসুদ পাপপু, জয়নাল আবেদীন ও শাহীন শিক্ষা পরিবার পরিচালক (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং) মারুফ হোসেন।

তামিম বলেন, এই মানুষগুলোর সহযোগিতা ও পরামর্শ ছাড়া আমি আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে পারতাম না। তারা সব সময় আমাকে ইতিবাচক ভাবে ভাবতে শিখিয়েছেন।

সমালোচনা নয়, কাজ দিয়ে উত্তর দিতে হয়। আমার পেছনে সমালোচকদের অভাব ছিল না। কেউ বলেছে, ‘এতে কিছু হবে না’, কেউ বলেছে, ‘গ্রামের ছেলে শহরে টিকতে পারবে না’। কিন্তু তিনি জানতেন, কঠোর পরিশ্রমই একমাত্র উত্তর।

তিনি হাসিমুখে বলেন, সমালোচকরা এখনো পেছনে পড়ে আছে। আমি তাদের ভুল প্রমাণ করেছি আমার কাজ দিয়ে। আজ আমি প্রমাণ করেছি গ্রামের সাধারণ ছেলে হয়েও বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব, যদি ইচ্ছা শক্তি দৃঢ় হয়। তামিম তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণা। তামিমের গল্প এখন দেশের অনেক তরুণের কাছে অনুপ্রেরণার নাম।

তার কথায়, জীবনে সফল হতে হলে বড় ডিগ্রি বা ধনসম্পদ নয়, দরকার স্বপ্ন দেখার সাহস আর তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার মনোভাব।

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাদের সৃজনশীলতা এবং ডিজিটাল দক্ষতা। তাই তিনি তরুণদের উদ্দেশে বলেন, নিজেকে কখনো ছোট মনে কোরো না। তোমার পরিশ্রমই তোমার পরিচয়। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।

গ্রামের ছোট্ট ঘর থেকে শুরু করে করপোরেট দুনিয়ার চূড়ায় উঠার গল্পটা কোনো অলৌকিকতা নয়। এটা এক মানুষের নিরলস পরিশ্রম, সততা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।

মুজাহেদুল ইসলাম তামিমের জীবন কাহিনী আমাদের শেখায়। অভাব কোনো বাধা নয়, সমালোচনা কোনো প্রতিবন্ধক নয়,আর স্বপ্নই মানুষকে গড়ে তোলে তার প্রকৃত রূপে।

তিনি নিজেই বলেন, আমি বারবার প্রমাণ করতে চেয়েছি, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। স্বপ্নের সমান বড় মানুষ: কৃষকের ছেলেকে ডিরেক্টর জেনারেল বানিয়েছে ইচ্ছাশক্তি।

NJ
আরও পড়ুন