দেশের প্রাচীন নির্দশনের ঐতিহ্যবাহী মসজিদগুলোর মধ্যে একটি উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের মির্জাপুর শাহী মসজিদ। সাড়ে তিনশ বছরের এ মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব সম্পদের পাশাপাশি পর্যটন শিল্পে ব্যাপক গুরুত্ব বহন করছে। পঞ্চগড় জেলা শহরের ১৮ কিলোমিটার দূরে আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে অবস্থিত এ মসজিদটি।
মসজিদটি দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে যাচ্ছেন আটোয়ারীর মির্জাপুরে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে প্রাচীন নির্দশনের এ মসজিদটি।
ঐতিহাসিকদের মতে, এ মসজিদের বয়স সাড়ে তিনশত বছর। প্রাচীন এ মসজিদটি ১৬৫৬ সালে নির্মাণ হলেও নির্মাণকাল নিয়ে রয়েছে মতভেদ।
মসজিদের শিলালিপি ঘেঁটে প্রত্নতত্ববিদের ধারণা, মসজিদটি ১৬৫৬ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। কারণ হিসেবে তারা দেখছেন, ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে (সম্ভাব্য) ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে নির্মিত মসজিদের সাথে এ মসজিদের সাদৃশ্য রয়েছে। এ কারণে মসজিদটি সমসাময়িককালে নির্মিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

কেউ কেউ মনে করেন মসজিদটি নির্মাণ করেছেন মালিক উদ্দিন নামে মির্জাপুর গ্রামেরই এক ব্যক্তি। জনশ্রুতি রয়েছে ওই ব্যক্তি মির্জাপুর গ্রামটিও প্রতিষ্ঠা করেছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন দোস্ত মোহাম্মদ নামের এক জনৈক ব্যক্তি। তবে প্রাচীন এ মসজিদটি মুঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- এতে একমত সবার। মসজিদটিতে মুঘল স্থাপত্য রীতির সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে।
মসজিদের দরজার উপরিভাগে পারস্য ভাষায় লিখিত মধ্যবর্তী ফলক রয়েছে। ফলকের ভাষা ও লিপি অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে, এ মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় মুঘল সম্রাট শাহ আলমের রাজত্বকালে। মসজিদটির দেয়ালে টেরাকোটা ফুল লতাপাতার নকশা খোদাই করা রয়েছে। এর সম্মুখভাগের আয়তাকার টেরোকোটা নকশার সাথে অন্যটির কোন মিল নেই।
মসজিদের দেয়াল থেকে কিছু উদ্ধারকৃত শিলালিপি থেকে অনুমান করা হয় ১৬৫৬ সালের দিকে নির্মাণ করা হয়েছে মসজিদটি। ভারতের সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার শাসনামলে শাহী মসজিদের নির্মাণ কাজ করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়।
মসজিদটি বিখ্যাত হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে এর নির্মাণ দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো। আলাদা আলাদা নকশা হওয়ার দৃষ্টিনন্দনের কারণে যে কাউকে মুগ্ধ করেন। মসজিদটিতে সাপ্তাহিক শুক্রবার জুমআর নামাজে অংশ নেন প্রচুর মুসল্লি।

এছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে মসজিদের নকশা খচিত কারুকাজ দেখার জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ ছুটে যান এ মসজিদটিতে। অনেকেই আবার স্মৃতি ধরে রাখতে নামাজ আদায় করেন।
মসজিদটি ঘুরে দেখা যায়, দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামোর প্রাচীন নির্দশনের ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। মসজিদের দৈর্ঘ্য হলো ৪০ ফুট ও প্রস্থ ২৫ ফুট। এর চার কোণে রয়েছে ৪টি মিনার। সামনের দেয়ালের দরজার দুইপাশে গম্বুজের সঙ্গে মিল রেখে দুইটি মিনার দৃশ্যমান। মসজিদের দেয়ালে ব্যবহার করা ইটসমূহ চিকন, রক্তবর্ণ ও বিভিন্ন অলংঙ্কৃত এবং দেয়ালের চারপাশ ইসলামি দোরাকাটা ফুল ও লতাপাতার নকশায় পরিপূর্ণ। বিশেষ করে মসজিদের মধ্যবর্তী দরজায় ফারসি লিপি খচিত মুদ্রার কালো ফলক, ফলকের লিপি ও ভাষা থেকে অনুমান করা যায়, এ মসজিদটি মুঘল সম্রাট শাহ আলমের শাসনামলে নির্মিত হয়েছে।
মুঘল স্থাপত্য রীতির বৈশিষ্ট্য ভরপুর সুসজ্জিত মির্জাপুর শাহী মসজিদের গম্বুজের শীর্ষবিন্দু ক্রম হ্রাসমান বেল্ট দ্বারা যুক্ত। রয়েছে ৩টি বড় বড় দরজা। মসজিদের ভেতরের দেয়ালে খোদাই করা কারুকার্য বিভিন্ন রঙের এবং বিভিন্ন ফুল, লতাপতাসহ কোরআনের সংবলিত ক্যালিওগ্রাফি তুর্কির ছোঁয়ায় সজ্জিত করা। এসব চিত্রগুলো পর্যটকদের নিয়ে যাবে প্রাচীনকালের সেই মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে।
মসজিদটির সামনের বাম পাশে রয়েছে দুটি কবর। স্থানীয়দের মতে, কবর দুটি দিতে জামাল বেগ ও কামাল বেগের। তারাই নির্মাণ করেছিলেন মসজিদটি।

তবে মতপ্রার্থক্য থাকায় সুনির্দিষ্ট হওয়া যায়নি কারা নির্মাণ করেছিলেন এ মসজিদটি। মসজিদটির সামে রয়েছে উন্মুক্ত খোলা জায়গা। সুসজ্জিত পাকা তোরণসহ মসজিদের উভয় পাশে রয়েছে নকশা ও খাঁজ করা স্তম্ভ। স্তম্ভগুলোর মাঝে চ্যাপ্টা গম্বুজ, তোরণকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। আর সুসজ্জিত গম্বুজের উপরে দেখা যায় মুদ্রার আকৃতি চূড়া। প্রাচীন এ মসজিদটির বয়স কয়েকশ বছর হলেও এখন পর্যন্ত কোন ক্ষতি হয়নি। ইটের গাথুনি, দেয়াল, প্লাস্টার ও নকশাসহ সব কারুকাজ শক্ত ও মজবুতভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

মির্জা বংশীয় উত্তরসূরীগণের অভিমতে জানা যায়, মির্জাপুর গ্রামের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পূর্বপুরুষ ফুল মোহাম্মদ। তিনিই এই মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করেন। পরে ফুল মোহাম্মদের ভাই দোস্ত মোহাম্মদ (সম্ভাব্য) এর নির্মাণকাজ শেষ করেন। এক সময় প্রবল ভূমিকম্পে মসজিদটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রায় ২০০ বছর আগে মুলুকউদ্দীন বা মালেকউদ্দীন হুগলির মসজিদের ইমামের মাধ্যমে ইরান থেকে কারিগর এনে মসজিদের মেরামত ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ সম্পন্ন করেন বলে ধারণা করা হয়। এরপর থেকে আর কোনো প্রকার সংস্কারের কাজ হয়নি।
মসজিদের সামনে একটি পুকুর রয়েছে, পুকুরের সামনে রয়েছে ফুলের বাগান। পুকুর পাড়ে দাড়ালে দর্শনার্থীরা আরও মুগ্ধ হন। মসজিদের একপাশে প্রায় ৫০ গজ দূরে রয়েছে ইমামবাড়া বা হোসেনি দালাল। ইটের তৈরি ইমামবাড়াটি ভেতরে গোলাকার এবং একটি কক্ষ রয়েছে। এ ইমামবাড়ার ভেতরের কক্ষে মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হতো।
স্থানীয়রা জানান, সেখানে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে ধর্মীয় নেতারা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতেন। তবে জরাজীর্ণ ও অসংরক্ষিত হিসেবে ইমামবাড়াটি পড়ে রয়েছে।
স্থানীয় মীর্জা মো. হাফিজ বলেন, প্রাচীন এ মসজিদটির নির্মাণকালের সময়টা বলতে পারবো না। তবে এটি ১৬৫৬ সাল থেকে ১৭০০ সালের মধ্যে এটি নির্মাণ হয়েছে বলে ধারণা। ২/৩ বার ভূমিকম্পের ফলে ফাটল ধরেছিল, পরে তা সংস্কার করা হয়েছে। জায়গার সংকুলান হয়েছে। বিশেষ করে এ অঞ্চলে এ ধরণের ঐতিহ্যবাহী কোন মসজিদ না থাকায় এ মসজিদে অনেক মুসল্লি নামাজ পড়তে আসেন।
মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. রবিউল ইসলাম বলেন, আমি এ মসজিদের খাদেম। এ মসজিদে আজান দেই। এ মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজ হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন বয়সী পর্যটকরা আসেন। তারা দেখেন, দান করেন। মসজিদটি অতি প্রাচীনতম। যে কেউ দেখতে আসলে তাদের ভালো লাগবে।

সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা নুরুল ইসলাম হেলাল বলেন, আর্কিওলজির তথ্যমতে প্রাচীন এ মসজিদটি ১৬৫৬-১৬৭৬ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল। আমাদের জানা মতে, মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন জামাল বেগ ও কামাল বেগ। পরবর্তীতে ১৮শ শতাব্দি থেকে মুলুকদীন মন্ডল এবং ফুল মোহাম্মদ এ মসজিদটি প্রথম সংস্কার করেন। দ্বিতীয়বার ১৯৬৪-৬৫ সালে সংস্কার করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৩-৯৪ সালে মসজিদটি আর্কিওলজির তত্ত্বাবধানে সংস্কার করা হয়। ২০১১ সালে ভূমিকম্পের কারণে মসজিদটির ফাটল ধরলে স্থানীয় মুসল্লীদের সহযোগিতায় ২০১২-১৩ সালে সংস্কার করা হয়।
তিনি আরও বলেন, পূর্ব পুরুষরা ভারতের মুঙ্গের প্রদেশ থেকে আজ থেকে সাড়ে ৫শ বছর আগে এখানে এসেছিলেন। তারা কোন জমিদারি রাজত্ব না করে তারা ধর্ম প্রচারের জন্যই এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এ মসজিদটি আজও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। নি:সন্দেহে বলতে পারি তারা ধর্ম প্রাণ মুসলমান ছিলেন। মসজিদটি ঐতিহ্য বহনের পাশাপাশি পর্যটন শিল্পেও গুরুত্ব তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এসে মসজিদটি দেখতে আসেন।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুসনে জাহান বলেন, পঞ্চগড়ের সাড়ে তিনশত বছরের প্রাচীন মসজিদ হচ্ছে আটোয়ারীর মির্জাপুর শাহী মসজিদ। এটি শুধু আটোয়ারী নয়, এটি পঞ্চগড়ের জেলার অন্যতম মুসলিম ঐতিহ্য বহন করছে। আমার মতে, শুধু পঞ্চগড় নয়, বৃহত্তর দিনাজপুরের মধ্যে মসজিদটি অন্যতম। ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে নির্মিত মসজিদের সাথে এ মসজিদের সাথে রয়েছে সাদৃশ্য। এ কারণে মসজিদটি সমসাময়িক কালে নির্মিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যার কারণে মুঘল আমলেই এটি নির্মাণ হয়েছে। এটি উত্তরাঞ্চলের পর্যটন শিল্পেও অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করছে। মুসলিম ঐতিহ্য হিসেবে মসজিদটির সংস্কার প্রয়োজন।
জেলা প্রশাসক মো. সাবেত আলী জানান, পর্যটন রসদে ভরপুর উত্তরের এ জেলা পঞ্চগড়। এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে মির্জাপুর শাহী মসজিদটি পঞ্চগড়ে এক অন্যতম নিদর্শন। মসজিদ সংরক্ষণ ও সংষ্কার করার বিষয়ে আমরা আরও নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়েছি। বিশেষ করে পঞ্চগড়ে পর্যটন শিল্প উন্নয়নে আমরা নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। পর্যটকরা যাতে এখানকার প্রাচীন নির্দশন দেখার পাশাপাশি ভ্রমণে আরও বিনোদন পায় সেজন্য আমরা জেলার মীড়গড়ে গড়ে তোলা হয়েছে ইকোপার্ক। আশা করছি, শতশত বছরের এসব প্রাচীন নির্দশনগুলো পর্যটকদকের অজানা ইতিহাস সমৃদ্ধ করবে।
