গত বছর জুলাই আন্দোলনে আহতদের দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন তিনি সেখানকার চিকিৎসকদের ‘নো রিলিজ নো ট্রিটমেন্ট’ নির্দেশনা দেন বলে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তে উঠে এসেছে। এবার আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া এক শিক্ষার্থী সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, তিনি নিজে শেখ হাসিনার এই নির্দেশনার কথা শুনেছেন।
সোমবার (৪ আগস্ট) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১–এ মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল ইমরান।
এদিন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় আসামি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দিনের মতো জবানবন্দি নেওয়া হয়।
জবানবন্দিতে আবদুল্লাহ আল ইমরান জানান, তিনি তখন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংক এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। তার বাঁ হাঁটুর নিচে গুলি লাগে।
শেখ হাসিনার পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনে যাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গত বছরের ২৬ অথবা ২৭ জুলাই সকাল ৯টা-১০টার দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। একপর্যায়ে তিনি আমার কাছে আসেন। শেখ হাসিনাকে আমি ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করি। তিনি তখন ‘আপা’ বলে ডাকতে বলেন।
ইমরান জানান, তখন শেখ হাসিনা তিনি কোথায় পড়াশোনা করেন, হলে থাকেন কি না, কেন থাকেন না, সে সম্পর্কে জানতে চান। তিনি বলেন, একপর্যায়ে শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন, আমি আন্দোলনকারী। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, পুলিশ তোমাকে গুলি করেছে? আমি বলি, পুলিশ আমাকে সরাসরি গুলি করে। পুলিশের পোশাকে কারা ছিল, সেটা আমি জানি না। আমার পর আরও চার থেকে পাঁচজনের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। পরে শেখ হাসিনা যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন হেল্পডেস্কের কাছে গিয়ে ‘নো রিলিজ নো ট্রিটমেন্ট’ অর্ডার দিয়ে যান, যা আমি শুনতে পাই।
তবে ইমরান জানান ‘নো রিলিজ নো ট্রিটমেন্ট’ মানে কী, তখন তিনি বুঝতে পারেননি। পরে তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেন। তিনি বলেন, একপর্যায়ে দেখি যথাসময়ে অস্ত্রোপচার হচ্ছে না। বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে পারছি না। আমার বাবা হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে চাইলেও নিতে পারছিলেন না। তখন বুঝতে পারি ‘নো রিলিজ নো ট্রিটমেন্ট’–এর মানে। তার পা কেটে তাকে কারাগারে নিতে চেয়েছিল বলেও তিনি সাক্ষ্যতে দাবি করেন।
এ ঘটনার জন্য আবদুল্লাহ আল ইমরান শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দায়ী করেন আবদুল্লাহ আল ইমরান।
এর আগে গতকাল রোববার (৩ আগস্ট) মামলার প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন আন্দোলনে আহত খোকন চন্দ্র বর্মণ (২৩)। তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশ 'পাখির মতো' গুলি চালিয়েছিল। খোকন বলেন, ‘যারা হাজার হাজার মানুষকে মেরেছে, তাদের জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এবং সাবেক এমপি শামীম ওসমান দায়ী। আমি তাদের বিচার চাই। বিচার হলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।’
আজ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম শুনানি করেন। এ সময় অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনার পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়া আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
গতকাল এই মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের পর ট্র্যাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষ্য দেন খোকন চন্দ্র বর্মন। তিনি গত বছরের ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় তার সামনে সংঘটিত হতাহতের ঘটনা ও গুলিতে নিজের মুখমণ্ডল বিকৃত হওয়ার বিষয়ে সাক্ষ্য দেন। পরবর্তীতে গতকাল তাকে জেরা করা শেষ হয়।
