নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় দখলে সাবেক ও বর্তমানদের দ্বন্দ্ব

আপডেট : ১৫ মে ২০২৫, ১১:০৬ পিএম

বেসরকারি নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় দখল নিতে মরিয়া প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক কয়েকজন সদস্য। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তারা বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের হুমকি-ধমকি দিয়েছেন। দখল ফিরে পেতে আবেদন করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। আবার বর্তমান ট্রাস্টিরাও বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজেদের কব্জায় রাখতে মরিয়া।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি দখলে নিতে মরিয়া এক পক্ষ, অন্য পক্ষ কব্জায় রাখতে করছেন দৌড়ঝাঁপ। দুই পক্ষের এমন দ্বন্দ্বে এক সময়ের জনপ্রিয় এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষা কার্যক্রমে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

দুই পক্ষের বিরোধ মিটিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) যথাযথ ভূমিকা জরুরি। অথচ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারককারী এ সংস্থাটির ভূমিকা নিয়ে উল্টো প্রশ্ন উঠেছে। দখল-কব্জার দ্বন্দ্বে ইউজিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

তবে পক্ষপাতদুষ্টতা থেকে বেরিয়ে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে ফুল কমিশন সভা ডেকেছে ইউজিসি। বৃহস্পতিবার (১৫ মে) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে এ সভা শুরু হবে। অচলাবস্থা নিরসনে এ সভা থেকে নতুন সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

দখল-বেদখলের বৃত্তে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়
২০০২ সালের ২৭ আগস্ট নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি সংক্ষেপে ‘আইবিএটি ট্রাস্ট’ নামে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ১৭ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন ও পরিচালনার অনুমতি দেয়। অস্থায়ী ক্যাম্পাস করা হয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে।

জনপ্রিয়তা পাওয়ায় নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৯টি প্রতিষ্ঠান গঠন করে। এর মধ্যে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দান মেডিকেল কলেজ, নর্দান কলেজ অন্যতম। সেসময় সাত সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডে ছিলেন অধ্যাপক মো. শামসুল হক, মো. আবু বকর সিদ্দিক, আবু আহমেদ, মো. লুৎফর রহমান, মো. বোরহান উদ্দিন, আয়েশা আক্তার ও মো. রেজাউল করিম।

২০১১ সালে এনইউবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে এবং আর্থিক সংকটে পড়লে তৎকালীন ট্রাস্টি বোর্ডের অধিকাংশ সদস্য আইন অনুযায়ী পদত্যাগ করেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিন। পরবর্তীসময়ে গঠিত নতুন ট্রাস্টি বোর্ড দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে আসছেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হঠাৎ করেই লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিন নিজেদের নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি হিসেবে পরিচয় দিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে আবেদন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোস্তফা শহীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘নর্দান ভার্সিটি আইবিএটি ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী আমানত দেখিয়ে প্রচুর ব্যাংক ঋণ নেওয়া হয়, যা ট্রাস্টিরা ভাগ করে নেন। ২০১০ সালে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা তৈরি করে। তখন স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আগের ট্রাস্টিরা বিনিয়োগে ব্যর্থ হন। পরে ২০১১ সালের ২৭ জুলাই বোরহান উদ্দিন, লুৎফর রহমান পদত্যাগ করেন এবং তারা তাদের প্রাপ্য হিস্যা নিয়ে যান। যার রেকর্ডও আছে। একই সঙ্গে অধ্যাপক ইউসুফ আব্দুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দায়-ঋণ পরিশোধ করেন।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা-লুটপাট, অবরুদ্ধ উপাচার্য
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতন হয়। এর দুদিন পরই নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে নেতৃত্ব দেন সাবেক ট্রাস্টি বোরহান উদ্দিন ও লুৎফর রহমান সানি। তারা উপাচার্যকে জিম্মি করে বিশ্ববিদ্যালয় দখলের চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিহত করেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং বোরহান ও লুৎফরকে আটক করেন। পরে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়।’

কিছুদিন পরই বনানীর প্রাসাদ ট্রেড সেন্টারে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। অফিসে সেদিন লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। একই সময়ে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যানসহ ট্রাস্টি বোর্ডের প্রায় সবাইকে আসামি করে জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের হত্যা মামলা করা হয়।

ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বর্তমান সদস্যদের অভিযোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা পুঁজি করে একটি চক্র বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে লুটপাট করেছে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নিতে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের নামে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা করেছে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক সামসুল হকের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় দখলের জাল দলিলে সই করানোর অপচেষ্টাও চালানো হয়। এ ঘটনায় বনানী থানায় অভিযোগ করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নিতে মরিয়া সাবেক ট্রাস্টি বোরহান উদ্দিন জানান, দায়-দেনা পরিশোধ না করে ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ আলাদা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন। যার সব সদস্যই তার নিকটাত্মীয়। এরপর পুরোনো ট্রাস্টিদের বের করে তিনি প্রতিষ্ঠানটি দখল করেন।

হামলা-লুটপাট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের ডেকেছিল। আমরা কথা বলতে গিয়েছিলাম। পরে তারা সেনাবাহিনী ডেকে আমাদের তাদের হাতে তুলে দেয়। আমরা কোনো হামলা-লুটপাট করিনি। অথচ তারা আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, জেলে পাঠিয়েছে।’

তবে বোরহান উদ্দিনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকার তথ্য ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক ও সিন্ডিকেট সদস্যরা। তাদের দাবি, তিনি স্বপ্রণোদিত হয়েই নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ঝামেলার সূত্রপাত করেন।

MMS