ফরাসি রিভিয়ারার আকাশে নক্ষত্রদের ঝলকানি, জ্বলজ্বলে রেড কার্পেট, আর বিশ্বের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সমাবেশ—এটাই কান চলচ্চিত্র উৎসবের চিরাচরিত রূপ।
এবছর, ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসব তার যাত্রা শুরু করেছে এবং শুরুর দিনেই এটি এক নতুন রাজনৈতিক ও চলচ্চিত্রগত প্রেক্ষাপটে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। উৎসবটি শুরু হলেও এর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজনৈতিক চাপ ও বিতর্কের তুমুল বাতাস।
রাজনৈতিক উত্তেজনা ও গাজার পরিস্থিতি
এ বছর কান উৎসবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটির সঙ্গে একযোগে, হাজার হাজার চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, শিল্পী ও পরিচালক গাজার নিরীহ মানুষের প্রতি ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেছেন। রিচার্ড গির, সুসান সারানডন, পেড্রো আলমোদোভর, এবং মাইক লি সহ ৩৮০ জনেরও বেশি চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব গাজায় চলমান যুদ্ধকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে অভিহিত করেছেন এবং এর বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা সেপ্টিডেহ ফার্সি, যিনি গাজার ফটো সাংবাদিক ফাতিমা হাসুনা-এর ওপর একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন, কানের আয়োজকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘গাজার ওপর চলমান অবরোধ ও বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করা উচিত।’ ফাতিমা হাসুনা নিজেই গত মাসে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হন, এবং তার এই মৃত্যু চলচ্চিত্র জগতে গভীর শোকের সৃষ্টি করেছে।
গাজা ইস্যুতে এই বছরের কান জুরির সভাপতি জুলিয়েট বিনোশকে প্রথমে আয়োজকরা বলেছিলেন যে তিনি আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন কিন্তু তার মুখপাত্র এএফপিকে বলেছেন যে তিনি এটি সমর্থন করেননি।
কান উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চ: রবার্ট ডি নিরো এবং নতুন ফিল্ম
মঙ্গলবার (১৩ মে) কান চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রবার্ট ডি নিরো, যিনি তার অভিনয় জীবনের জন্য অনারারি পাম ডি’অর পুরস্কার গ্রহণ করেন। কানের অভিজ্ঞান অনুযায়ী, এই পুরস্কার তাকে দেওয়া হয়েছে তার অসাধারণ চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের জন্য।
এবারের উদ্বোধনী ফিল্মটি ছিল অ্যামেলি বনিন-এর ‘লিভ ওয়ান ডে’, যা ফ্রান্সের প্রথম ডেবিউ পরিচালকের হাতে উদ্বোধনী স্লট পাওয়ার একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমেলি বনিন তার প্রথম চলচ্চিত্রেই প্রমাণ করেছেন যে, তিনি শিল্পের একটি নতুন ধারা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। এই উৎসব চলবে আগমী ২৪ মে পর্যন্ত।
এই বছরের কান: প্রতিযোগিতা, তারকার উপস্থিতি ও চলচ্চিত্রের বৈচিত্র্য
এ বছর, কান চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে অংশ নিয়েছে বিশ্বব্যাপী অগণিত নামকরা পরিচালক। পেড্রো আলমোদোভর, ওয়েস অ্যান্ডারসন, লিন রামসে, জোনাথান গ্লেজার, জাফর পানাহী, এবং কারলা সিমোন সহ অনেকেই তাদের নতুন সিনেমা নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। এসব চলচ্চিত্রের মধ্যে কিছু বিশেষ দর্শনীয় যা অন্তর্ভুক্ত করেছে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের উপর নির্মিত কাজ।
এছাড়া, টম ক্রুজ তাঁর ‘মিশন: ইম্পসিবল’ সিরিজের নতুন কিস্তি নিয়ে কান ফিরছেন, তিন বছর পর ফের তার সিনেমা প্রদর্শিত হবে এই উৎসবে। ‘টপ গান: মাভেরিক’-এর পর আবারও কান রেড কার্পেটে তার ঝলকানি দেখা যাবে।
বাংলাদেশ ও ‘আলী’
এবারের আসরে জমা পড়েছে ৪ হাজার ৭৮১টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এর মধ্য থেকে প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হয়েছে ১১টি। বাংলাদেশের ‘আলী’ সেগুলোরই একটি। এর মাধ্যমে কানের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে প্রথমবার উড়বে লাল-সবুজ পতাকা। ১৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবিটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আল আমিন। আলীর মায়ের ভূমিকায় আছেন ইন্দ্রানী সোমা। এর গল্পে দেখা যাবে, বাংলাদেশের উপকূলীয় একটি শহরে নারীদের গান গাওয়ার অনুমতি নেই। সেখানকার এক কিশোর শহরে চলে যাওয়ার সুযোগ পেতে একটি গানের প্রতিযোগিতায় নাম লেখায়। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, সে তার আসল কণ্ঠস্বর লুকিয়ে রাখে!
মূল প্রতিযোগিতায় ২২টি ছাড়াও আঁ সাঁর্তে রিগা বিভাগে ২০টি, প্রতিযোগিতার বাইরে ১২টি, কান প্রিমিয়ারে ১০টি, স্পেশাল স্ক্রিনিংসে ৯টি, কান ক্ল্যাসিকসে ৩০টি, সিনেমা দ্যু লা প্লাজে ১৬টি, শর্টফিল্ম প্রতিযোগিতায় ১১টি, শিক্ষার্থী নির্মাতাদের বিভাগ লা সিনেফ-এ ১৬টি ও ইমারসিভ প্রতিযোগিতায় ১৬টিসহ মোট ১৬২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য, মাঝারি দৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। কান উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বর্ণপাম। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে গ্রাঁ প্রিঁ, জুরি পুরস্কার, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা, সেরা অভিনেত্রী, সেরা চিত্রনাট্য ও সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
বিশ্ব চলচ্চিত্রের সঙ্গেই কান উৎসবের সখ্যতা
কান চলচ্চিত্র উৎসব কেবল ফ্রান্সের জন্য নয়, এটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক মহাসমাবেশ। এর মাধ্যমে প্রতিটি দেশের সিনেমা শিল্পকে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরা হয়। এ বছরের কান উৎসবে অনেক সিনেমা হল, চলচ্চিত্র নির্মাতা, পরিচালক এবং অভিনেতা নিজেদের উপস্থিতি জানিয়ে উৎসবের এক অনন্য অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছেন। উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হলো ‘ইউক্রেন ডে’, যেখানে রাশিয়ার আক্রমণে বিধ্বস্ত ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে তিনটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হবে।
অবশেষে, চলচ্চিত্র ও রাজনীতি একাকার
এ বছরের উৎসবে রাজনীতি এবং চলচ্চিত্র একে অপরকে আরও একবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। বিশ্বের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর তার সাথে সঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাদের কাজের মাধ্যমে রাজনৈতিক বার্তা দিতে থাকছেন। পরিচালকরা কেবল সিনেমা নির্মাণে সীমাবদ্ধ না থেকে, তারা তাদের কাজের মাধ্যমে পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটানোর জন্য একধাপ এগিয়ে চলেছেন।
এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবটি যেমন তার চিরাচরিত ধারা মেনে শুরু হয়েছে, তেমনি এটি নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সৃষ্ট শক্তিশালী বার্তা নিয়েও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
