ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

বহিমান সত্তা॥ বিল্লাল বিন কাশেম

আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩১ পিএম

অনেক দিন হচ্ছে কেবল বিষণ্নতা গ্রাস করছে। শরীর ভালো নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় মনের মধ্যে একধরনের জড়তা জমে আছে, যেমন পুরনো কাপড়ে ধুলোর স্তর পড়ে।

সকালে ঘুম থেকে উঠলেই মনে হয়-আজও কিছু হবে না। একদিন, দুইদিন নয়, মাসের পর মাস এই একই ভাবনা।

আমি নিয়মিত যোগব্যায়াম করি। ইউটিউবে দেখে ধ্যান করি, মোমবাতি জ্বালিয়ে নরম আলোয় বসে থাকি। নিজের ভেতর মনোযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করি, কিন্তু কিছুই হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি আসলে নিজের ভেতরে কিছুই খুঁজে পাইনি, তাই মনোযোগও স্থাপন হয় না।

একদিন সকালে চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে ছিলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, আমি হারিয়ে গেছি।
কোথায় যেন এক বহিমান সত্তা আছে-আমার চেয়ে বড়, আমার ভেতরেই কোথাও বাস করছে, আমি তার নাগাল পাচ্ছি না।

এই চিন্তা মাথায় আসার পর থেকেই কেমন যেন অস্থিরতা বাড়ল।

আমাদের বাড়িটা পুরনো। কাঠের জানালা, মরচে পড়া গ্রিল, বারান্দায় মানানসই একটা গাছ-দুপুরের আলোয় সেই গাছের ছায়া মেঝেতে পড়ে। আমি সেই ছায়ায় অনেক সময় কাটাই।

ভাইবোনেরা এখন ব্যস্ত নিজেদের সংসারে। মাঝে মাঝে ফোন করে, কিন্তু কথা ছোট হয়।
“কেমন আছ?”
“ভালো।”
তারপর নিঃশব্দ বিরতি।
“তুমি?”
“আমিও ভালো।”
তারপর কল শেষ।

এই সংলাপটা এমনই যান্ত্রিক হয়ে গেছে যে মনে হয়, রোবটদের মধ্যে আলাপ চলছে।

একদিন বিকেলে বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল। আমি জানালার পাশে বসে ছিলাম। তখন হঠাৎ একটা আওয়াজ পেলাম। মনে হলো, কেউ আমার ঘরের দরজায় টোকা দিল। দরজা খুলে দেখি-কেউ নেই।

আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে নিঃস্তব্ধতা। দূরে শুধু বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ।
ফিরে এসে বসে পড়লাম। পাঁচ মিনিটও হয়নি, আবার টোকা।

এইবার দরজা খুলতেই দেখি, এক তরুণ দাঁড়িয়ে। বয়স আনুমানিক ত্রিশের কাছাকাছি, ফর্সা গায়ের রঙ, চোখদুটো অদ্ভুত উজ্জ্বল।
সে হাসল। বলল,
-“আপনি কি বিল্লাল সাহেব?”
-“হ্যাঁ, কিন্তু আপনি?”
-“আমি অরূপ।”
-“অরূপ?”
-“হ্যাঁ। আপনি যাকে খুঁজছিলেন, আমি সেই বহিমান সত্তা।”

আমি হেসে ফেললাম।
-“কি বলছেন? আপনি কে? কোথা থেকে এলেন?”
-“আপনার ভিতরের জগৎ থেকে। আপনি তো এতদিন ধরে আমাকে ডাকছিলেন, তাই চলে এলাম।”

আমি স্তম্ভিত। মনে হলো লোকটা পাগল।
কিন্তু তার চোখদুটো এমন শান্ত, এমন স্থির-যেন সেগুলো মিথ্যা বলতে জানে না।

অরূপ খুব স্বাভাবিকভাবে ঘরে ঢুকে পড়ল। টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসল।
বলল,
-“আপনি চিন্তা করছেন, আপনি আর আগের মতো লিখতে পারছেন না, তাই না?”
আমি বিস্মিত।
-“আপনি কিভাবে জানলেন?”
সে হেসে বলল,
-“কারণ আপনি আমিই। আমি সেই অংশ, যেটাকে আপনি ভুলে গেছেন। আপনার ভেতরের সৃষ্টিশীল সত্তা।”

আমি চুপ করে রইলাম। ভেতরে ভেতরে একটা শিরশির অনুভূতি হচ্ছিল।

অরূপ বলল,
-“আপনি খুব চেষ্টা করছেন মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু সেটা বাইরে থেকে সম্ভব নয়। ভিতরে ঢুকতে হবে।”
-“ভিতরে ঢোকা মানে?”
-“নিজেকে দেখা। কিন্তু তার আগে আপনাকে শূন্য হতে হবে।”

আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
অরূপ শান্ত গলায় বলল,
-“চলুন, আমি আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব।”

বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। আমরা হাঁটছি। রাস্তা ফাঁকা, বাতাসে কাদা ও পলির গন্ধ।
অরূপ সামনে হাঁটছে, আমি পিছনে। তার চলার ভঙ্গিটা এমন যে মনে হয় সে জানে ঠিক কোথায় যাচ্ছে।

একটা পুরনো পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে এসে থামল।
বলল,
“এই বাড়িটায় আপনি একসময় আসতেন।”
“আমি?”
“হ্যাঁ, শৈশবে। আপনার বাবার এক বন্ধুর বাড়ি। মনে আছে?”

আমি মনে করার চেষ্টা করলাম। সত্যি, ঝাপসা একটা স্মৃতি মনে পড়ল। আমি তখন ছোট, বাবার সঙ্গে এখানে এসেছিলাম। বাড়িটার নাম ছিল “চন্দ্রমল্লিকা লজ।”

অরূপ বলল,
“চলুন, ভিতরে যান।”

আমি কেমন যেন তাড়িত হয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম।
ভিতরে অদ্ভুত গন্ধ- পুরনো কাঠ, ধুলো, আর স্যাঁতসেঁতে বাতাস।
কোণার ঘরটায় একটা আয়না ছিল।
অরূপ বলল, “এই আয়নায় তাকান।”
আমি তাকালাম।
কিন্তু আয়নায় আমার মুখ নয়- দেখলাম এক তরুণ লেখক, যার চোখে আগুন। সে টেবিলে বসে লিখছে। একাগ্র, নিবিষ্ট। যেন পৃথিবীর আর কিছুই তার প্রয়োজন নেই।

আমি ভয়ে পিছিয়ে গেলাম।
-“এটা কে?”
অরূপ বলল,
-“এটাই আপনি ছিলেন।”
-“আমি?”
-“হ্যাঁ। সেই সময় আপনি নিজের ভেতরের আলো দেখতেন। এখন আপনি কেবল আলো খোঁজেন, কিন্তু তাকিয়ে থাকতে ভয় পান।”

আমার গা কাঁপতে লাগল। আমি আয়নার দিকে আবার তাকালাম। এবার সেই তরুণ উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল।
তার চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি- অর্ধেক ভালোবাসা, অর্ধেক তিরস্কার।

সে বলল,
“তুমি কেন আমাকে ভুলে গেলে?”

আমি কিছু বলার আগেই সব অন্ধকার হয়ে গেল।

চোখ খুলে দেখি আমি নিজের বিছানায় শুয়ে আছি। ঘরে কোনো অরূপ নেই।
টেবিলে একটা কাগজ। তাতে বড় হরফে লেখা- “তোমার ভিতরের বহিমান সত্তা কখনো হারায় না, তুমি ভুলে যাও মাত্র।”
আমি অবাক হয়ে কাগজটা হাতে নিলাম। মনে হলো, হয়তো সব স্বপ্ন ছিল।
কিন্তু পাশের টেবিলে একটা পুরনো কলম পড়ে আছে- যেটা আমি বহু বছর আগে হারিয়েছিলাম।

তারপর থেকে আমি আবার লিখতে শুরু করলাম। প্রথমে ছোট ছোট নোট। তারপর গল্প।
একদিন লিখতে গিয়ে মনে হলো, অরূপ যেন পাশে বসে আছে। আমি যখন একটা বাক্যে আটকে যাই, সে শান্তভাবে বলে
-“এইভাবে বললে কেমন হয়?”
আমি হেসে উত্তর দিই-
-“ভালোই তো!”

আমি জানি, হয়তো অরূপ বাস্তবে নেই।
কিন্তু একরকমের শান্তি ফিরে এসেছে।

একদিন লিখতে লিখতে জানালার বাইরে তাকালাম। দূরে আকাশে মেঘের ফাঁকে সূর্য উঠছে।
মনে হলো, কোনো এক বহিমান সত্তা আমার ভিতর থেকে হাসছে।

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ডায়েরিতে লিখলাম-

“বিষণ্নতা মানে ভেতরের শূন্যতা নয়, বরং ভুলে যাওয়া।
আমরা ভুলে যাই, আমাদের ভিতরে একটা আলো আছে। সেই আলো ফিরে পেলে জীবন আবার সহজ হয়ে যায়।”

দীপ নিভিয়ে দিলাম। বাইরে হালকা হাওয়া। অন্ধকারের ভিতরে আমি যেন অরূপের কণ্ঠ শুনতে পেলাম-
“তুমি ফিরে এসেছো, সেটাই যথেষ্ট।”

আরও পড়ুন