বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ‘আলালের ঘরে দুলাল’ স্বীকৃত। এর আগে প্রকাশিত হ্যানা ক্যাথরিন ম্যুলেন্সের ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ ও এক বছর পরে প্রকাশিত কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘বিজয়-বসন্ত’ প্রথম উপন্যাস হিসেবে কেন মর্যাদা লাভ করেনি, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা আছে।
রচনাকালের দিক দিয়ে হ্যানা ক্যাথরিন ম্যুলেন্সের ফুলমণি ও করুণার বিবরণ প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরে দুলালের আগে প্রকাশিত। ফুলমণি ও করুণার বিবরণ প্রকাশিত হয় ১৮৫২ সালে। আলালের ঘরে দুলাল প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে। আর কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের বিজয়-বসন্ত প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে। এইদিক বিবেচনা করলে ফুলমণি ও করুণার বিবরণ অগ্রাধিকার পায় এবং পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের গৌরব হ্যানা ক্যাথরিন ম্যুলেন্সের প্রাপ্য।
কলকাতার সমকালীন সমাজচিত্র আলালের ঘরের দুলাল গ্রন্থের বিষয়বস্তু। উচ্চবিত্ত ঘরের আদুরে সন্তান মতিলালের পদস্খলন ও শেষে সৎপথে ফিরে আসা উপন্যাসটির মূল প্রসঙ্গ। ঘটনাগুলো মতিলালকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু ঠকচাচা নামক চরিত্রই এই উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ। কাহিনির উত্থান-পতনের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চলে গেছে ঠকচাচার হাতে।
আলালের হালকা চালের কলকাতার ভাষা ‘আলালী ভাষা’ নামে পরিচিত। প্যারীচাঁদ মনে করতেন, এই চলিতঘেষা আধা সাধুভাষা, যাতে বহু স্থলে চলিত-সাধু-অসাধু উপভাষার বিচিত্র জগাখিচুড়ি তৈরি হয়েছে। এই ভাষাই নাকি কথাসাহিত্যের আদর্শ ভাষা। বিদ্যাসাগরীয় ক্লাসিকঘেষা গম্ভীর বাক্রীতি ঠিক উপন্যাসে উপযোগী নয়। বিদ্যাসাগরীয় পরিচ্ছন্নতা ও ক্লাসিক গাম্ভীর্য এবং আলালী সরসতার সমন্বয়ের ভাষাই কথাসাহিত্যের যথার্থ বাক্রীতি। বঙ্কিমচন্দ্র ভাষা-খনি হাতে নিয়ে কথাসাহিত্যের উপল-ঊষর ক্ষেত্রে আবির্ভূত হন এবং রসের ধারা বইয়ে দেন। তবে একথা ঠিক, প্যারীচাঁদ সর্বপ্রথম সহজ মানুষের দুষ্টু, খলচরিত্রের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার পরিচয় দিয়ে উপন্যাসের বাস্তবতার পথ তৈরি করেছিলেন।
আলালের ঘরের পুরোপুরি চলিত ভাষা নয়, মূল ঠাটটা সাধুভাষার ছাদ অনুসরণ করেছে, কিন্তু লেখক নাটকীয় প্রয়োজনে ভাষাকে তীর্যক ও চরিত্রানুরূপ রূপ দিয়েছেন। অবশ্য অনেক সময় চলিত ও সাধুভাষার সংমিশ্রণও করে ফেলেছেন, যেটা সেকালের প্রায় সব বাঙালি লেখকের মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছিল। অন্তত রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালি কথাসাহিত্যিকরা সাধু ও চলিতরীতির বর্ণনা ও সংলাপের পার্থক্য সম্বন্ধে সবসময় সচেতন থাকতেন না। যাই হোক, প্যারীচাঁদের উল্লেখিত দৃষ্টান্ত দুটি যে সহজ-সরল ও চলতি জীবনের উপযোগী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে প্যারীচাঁদ অবলম্বিত ভাষারীতি দুঃসাহসিক প্রচেষ্টার নিদর্শন হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃত হলেও এর ন্যূনতা এবং দুর্বলতা বিষয়েও আমাদের অবহিত হওয়া প্রয়োজন। তার ভাষা অনেকের দ্বারা সমকালে প্রশংসিত হলেও একালে আমরা যখন ভাষারীতির বিশুদ্ধতার বিষয়ে বেশি সচেতনতা লাভ করেছি তখন প্যারীচাঁদের ভাষারীতিতে সামঞ্জস্যতার অভাবকে কিছুটা পীড়াদায়ক বলেই মনে হয়।
উপন্যাসের কাহিনি নির্মাণে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও সমাজের বিভিন্ন খণ্ডচিত্রগুলো নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে। এছাড়া সেসময়ের সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষার রচনারীতির ধারা থেকে বের হয়ে এসে প্রথমে চলিতরীতিতে সাহিত্যরচনা প্রশংসার দাবি রাখে। সক্রিয় সত্তায় ভাস্বর এই সাহিত্যকর্মে তিনি শিল্পনৈপুণ্য ও রচনাশৈলী প্রদর্শন করেছেন, তা পরবর্তীতে আধুনিক উপন্যাসের পথকে মসৃণ করেছে।
১৮৫৯ সালে প্রকাশিত বিজয়-বসন্ত করুণ রসে সিক্ত নারী-অনুকূল কথাসাহিত্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এর মধ্যে একটা সম্মিলিত কাব্যাভাস রয়েছে বলে গদ্যটি যে সুপাঠ্য এবং গতি-বাক্যে মসৃণ, সেকথা অস্বীকার করা যায় না। এতে করে যথার্থ অনুমান করা যায়, বিজয়-বসন্ত যথার্থই পদ্য থেকে গদ্যে রূপান্তরিত হয়েছে।
জয়পুর রাজ্যের রাজা জয়ের দুই পুত্র বিজয় ও বসন্ত। ছোটবেলায় মা মারা যায়। দাসী শান্তার কাছে তারা বড় হতে থাকে। একদিন বিমাতার মিথ্যা অপবাদের শিকার হয়ে রাজা কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। কিন্তু মন্ত্রী কৌশলে তাদের মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। যেতে যেতে তারা সেখান থেকে দৈবক্রমে চলে যায়, দুই ভাই আলাদা হয়ে যায়। অনেক দুঃখ-কষ্ট-মানসিক পীড়ন শেষে দুই ভাই দুজনকে ফিরে পায়। পরে নিজ রাজ্যেও ফিরে আসে।
জনপ্রিয়তার দিক থেকে আলালের ঘরের দুলাল থেকে বিজয়-বসন্ত এগিয়ে কি না সে দাবি হুট করে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জনপ্রিয়তার তুঙ্গ বলতে যা বোঝায় সে সমৃদ্ধিকে কাঙালের বিজয়-বসন্ত যে স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছিল, সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
উপন্যাসের বিষয়বস্তু, সংলাপ, চারিত্র্যবিচার, সমাজ-সমকাল, অর্থনৈতিক অবস্থা, লেখকের দর্শন ও ভাষাশৈলী—এসবের বিচারে আলোচ্য তিনটি উপন্যাস ফুলমণি ও করুণার বিবরণ, আলালের ঘরের দুলাল ও বিজয়-বসন্তের কোনোটিই পরিপূর্ণ সার্থক উপন্যাস হিসেবে মর্যাদা লাভ করেনি। কিন্তু তারপরও উপন্যাসের বিভিন্ন গুণবিচারে সব সাহিত্যবোদ্ধা ও পণ্ডিতরা আলালের ঘরের দুলালকে অপেক্ষাকৃত এগিয়ে রেখেছেন। সে কারণে এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসের মর্যাদায় স্বীকৃত হতে পেরেছে।
