ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

নজরুলের ট্র্যাজেডি ॥ রকিবুল হাসান

আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২৫, ০২:৩১ পিএম

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে বিশাল এক ট্র্যাজেডি চরিত্র। বিশ্বসাহিত্যে যেসব  ট্র্যাজেডি আছে, নজরুল জীবন সেসব  ট্র্যাজেডি থেকেও কম বিস্ময়কর নয়। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের জন্য এ এক বিশাল দুঃখ। নজরুলের জীবনের পথ কখনোই সহজ ও মসৃণ ছিল না। গ্রিক  ট্র্যাজেডির মতো জন্ম থেকেই যেন তা নির্ধারিত ছিল। বিশাল প্রতিভার অধিকারী হয়েও তার পুরো বিকাশ ঘটাতে পারেননি।
 
কাজী নজরুল ইসলামের জন্মই দরিদ্র পরিবারে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় তার জন্ম হয়েছিল ঝড়ো রাতে। যে ঝড় সারাজীবনই যেন তাকে তাড়িত করেছে। মাত্র ৯ বছর বয়সে অর্থাৎ বাল্যকালেই তার বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক জীবনকে কঠিনের পথে ধাবিত করে দেয়। দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাত, অভিভাবকহীনতা, ছন্নছাড়া এলোমেলো জীবন নজরুল যেন ভয়ংকর এক ঝড়ে দিকহারা পাখি হয়ে পড়ে; চতুর্দিকে নেমে আসে অনিশ্চিত অন্ধকার। ভয়ংকর এই অন্ধকার ঠেলেই আলোর ফোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এ জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে ক্ষুধার সঙ্গে, দারিদ্র্যের সঙ্গে, ব্রিটিশদের সঙ্গে, এমনকি ব্যক্তিজীবনের নানা ঘটনার সঙ্গে। যার শুরু যেন জন্ম থেকেই।

নজরুলের জীবন নানাভাবে প্রতিকূলতার শিকার হয়েছে। ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে সেনাজীবন বেছে নিয়েছিলেন। সৈনিক জীবন শেষে দেশে ফিরে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য শুরু করেন অগ্নিবারুদের মতো গান কবিতা লেখা। সাধারণ মানুষের মধ্যে চেতনার অগ্নিশিখা জ্বালাতে থাকেন তিনি। ব্রিটিশ শাসক তা সহ্য করতে পারেনি। ফলে নজরুলকে কারাবরণ মেনে নিতে হয়। ব্রিটিশ শাসক তাকে কারাগারে রেখে তার লেখনির শক্তি থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাস্তবে হয়েছে এর উল্টো। নজরুলের কলম আরো বেশি অগ্নিময় হয়ে ওঠে। ফলে রাজরোষ নজরুলের জীবনে এক ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করে। জেল-জুলুম-অত্যাচার তার জন্য অবধারিত হয়ে ওঠে। কিন্তু তিনি কখনো আপসের পথে হাঁটেননি। জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তিনি ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’কে অতিক্রম করেছেন।

প্রেমে ব্যর্থতা, পারিবারিক জীবনে অর্থনৈতিক-কষ্ট, অসুস্থতা- সব দিক থেকেই তার জীবন প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছে। নার্গিসের সঙ্গে তার যে বিয়ে হয়েছিল, সেখানেও রচিত হয়েছে  ট্র্যাজেডি। বাসর রাতেই স্ত্রীকে ছেড়ে চিরকালের মতো তিনি চলে এসেছেন, আর কোনোদিন সেখানে ফেরেননি। কিন্তু তার অন্তরে যে আঘাত যে যন্ত্রণা তাকে বিদ্ধ করলো, তার থেকে মুক্তিও তিনি কোনোদিন পাননি। এ ছিল তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আপসহীনতা। নার্গিসের মামা আলী আকবর খানের প্রস্তাব ছিল তাকে ঘরজামাই হিসেবে থাকতে হবে। নজরুলের ব্যক্তিত্বের জন্য এ ছিল চরম আঘাত ও অবমাননা। যে বেদনা তিনি কোনোদিন ভুলতে পারেননি। 

এরপর ফজিলাতুন্নেসাকে নজরুল ভালোবেসে ব্যর্থ হন। ফজিলাতুন্নেসা সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের মেধাবী ছাত্রী। মুসলমান বাঙালি মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রথম এমএ পাস করেন। নজরুলের অপ্রতিরোধ্য মোহ ও আবেগ ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল শিক্ষিতা এই নারীর জন্যে। কিন্তু সেখানে তিনি নিদারুণ বেদনা ছাড়া আর কিছুই পাননি। প্রতিভা বসুর সঙ্গেও তার একটা নীরব সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিয়ের আগে তার নাম প্রতিভা সোম। তিনি অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন। ভালো নজরুলগীতি গাইতেন। মূলত তিনিই এ বাংলায় নজরুলের গান গেয়ে তাকে পরিচিত করে তুলেছিলেন। নজরুল ঢাকায় এসে প্রতিভা বসুর বাড়িতে দীর্ঘদিন ছিলেন। তাদের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রতিভা বসুর বাড়ির আশেপাশের হিন্দু তরুণেরা এ ব্যাপারটিকে সহজে গ্রহণ করতে পারেনি। সেকারণে ঢাকার ওয়ারিতে স্থানীয় হিন্দু ছেলেদের কাছে নজরুল শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন। নজরুলের জীবনে প্রেম এসেছিল নানা রঙে, নিজেও প্রেমে পড়েছিলেন, কিন্তু তৃপ্ততার সুশীতল সুধা তিনি কোথাও পাননি। 

ঝড়ের রাতে যার জন্ম, ঝড়ের মতো যার জীবন, বাংলা সাহিত্যে তার বার্তা ঝড়ের মতোই ছিল। ভারতে যখন  ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের উন্মাদনা চলছে। ১৯২০ সালে করাচি থেকে ফিরেই নজরুল ইসলাম সম্ভাব্য সাব-রেজিস্ট্রারের চাকরি না নিয়ে পুরোপুরি সাহিত্যে আত্মনিয়োগ করলেন। লিখতে থাকলেন অবিরল ধারায়। এর দুবছরের মধ্যেই লিখলেন আবহমান বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘বিদ্রোহী’। যা ছিল বাংলা সাহিত্যে রীতিমতো এক ঝড়ের আগমন, যা একেবারে অচেনা কিন্তু খুব প্রয়োজন, ভারতবাসীর জন্য এক নতুন বাণী।

এরপরেও যেটি সত্য সমকালে নজরুল একশ্রেণির মানুষের কাছে অবহেলা ও অবজ্ঞার শিকার ছিলেন। অনেকেই তাকে কবি হিসেবে মানতে নারাজ ছিলেন। তা যে মূলত ঈর্ষা সে বিষযে কোনো সন্দেহ থাকে না। অবশ্য এটি মধুসূদনের ক্ষেত্রেও হয়েছে। তার কবিতাকে অনেকে কবিতা হিসেবেই গ্রহণ করতে চাননি। অনেক বিরূপ সমালোচনা তাকে সহ্য করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথও এর থেকে মুক্ত ছিলেন না। তার কবিতাকে ভাব আর কল্পনার বলে অনেকে গ্রাহ্যে নিতে চাননি। যেকোনো বড় প্রতিভাকেই সমকালে সহজেই ধারণ করা কঠিন। গ্রহণ করার জন্য যে পরিমাণ মেধা ও শক্তি লাগে, গতানুগতিকতায় বন্দিদের তা কমই থাকে। ফলে গতানুগতিকতা ভেঙে নতুনের গান যারা গেয়েছেন, তাদের বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয়মাল্য উঠেছে তাদের গলায়ই। নজরুলের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ তা স্পষ্ট অনুভব করেছিলেন এই প্রতিভাকে অনেকেই না বুঝে না জেনে, তার কবিতার রূপ-রস অনুধাবন না করে তাকে অবজ্ঞা ও অবহেলার তীর নিক্ষেপ করেছে। সেকারণে তিনি তার ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করে একটি জবাবই দিয়েছিলেন। 

নজরুল ইসলাম হুগলি ছেড়ে অন্য কোনোখানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আর্থিক অভাব-অনটনের কারণেই। হেমন্তকুমার সরকার তাকে কৃষ্ণনগরে যাওয়ার কথা বললে তিনি রাজি হয়ে যান। ১৯২৬ সালের ৩ জুন নজরুল হুগলি-পর্ব শেষ করে কৃষ্ণনগরের চাঁদ সড়কের গ্রেট কটেজে বাসা নেন। এ বাড়িতেই তার প্রিয় পুত্র বুলবুলের জন্ম হয়েছিল। বুলবুলকে তিনি অসম্ভবরকম ভালোবাসতেন। মাত্র চার বছর বয়সেই অর্থাৎ ১৯৩০ সালের ৭-৮ মে বসন্ত রোগে বুলবুলের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুতে নজরুল মানসিকভাবে চরমভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। তার অসংখ্য কবিতা-গানে এই বেদনা ছড়িয়ে আছে। বুলবুলের রোগশয্যায় বসে তিনি অনুবাদ করেছিলেন কবি হাফিজের ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ। পরে এটি ‘রূবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ নামে গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি তিনি বুলবুলকে উৎসর্গ করেছিলেন।

এসবের কোনোটি থেকেই তিনি পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করতে পারেননি। এমনকি দারিদ্র্যের বৃত্ত থেকেই তিনি বেরিয়ে আসতে পারেননি। নজরুল ‘দৈনিক নবযুগ’-র প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ পত্রিকার মালিক ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। তিনিও নজরুলকে প্রাপ্য টাকা না দিয়ে বরং উল্টো আঘাত করেছিলেন। হাবীবুল্লাহ বাহারও নজরুলের ভাতা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নজরুল হাবীবুল্লাহ বাহার ও শামসুন্নাহারকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, তাদের বাড়িতে গিয়েছেন, থেকেছেন। তাদের চমৎকার সম্পর্ক ছিল। অথচ চরম দুর্দিনে হাবীবুল্লাহ বাহার তার পাশে তো দাঁড়ানইনি বরং বিপদকে আরও গভীরতর করে তুলেছিলেন। হাবীবুল্লাহ বাহার ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন, আর নজরুল ছিলেন খুবই অসুস্থ। তিনি ইচ্ছে করলে নজরুলকে বড় ধরনের সাহায্য করতে পারতেন। তা না করে বরং মিথ্যে অভিযোগ তুলে তার মাসিক ভাতা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

নজরুল দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে দুহাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেছিলেন, মাসিক দুশো টাকা সুদে। এই সুদের টাকা তিনি নিয়মিত পরিশোধ করতে পারেননি। সেকারণে কাবুলিওয়ালা তার বাড়ির দরজায় এসে লাঠি ঠুকিয়ে অপমানিত করতেন। মধুসূদন দত্ত নজরুলের মতোই 
পাওনাদারদের কাছে অপমান হয়েছিলেন। বাধ্য হয়ে অসুস্থ শরীরে নজরুল রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গিয়েছিলেন চাকরির জন্যে পরীক্ষা দিতে। সেখানে তাকে যোগ্য বিবেচনা করা হয়নি। যে দেশের মুক্তির জন্য সারাজীবন অগ্নিঝরা লেখনি লিখলেন, জেল খাটলেন, পথে-পথে আন্দোলন করলেন, সে দেশে বাঁচার জন্য ন্যূনতম একটি চাকরির জন্য তিনি যোগ্য বিবেচিত হননি!

১৯৪২ সালে ৯ জুলাই কলকাতা বেতারে শিশুদের একটি অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের সময় বাকরুদ্ধ হয়ে যান তিনি। এর পর আর কোনোদিনই তিনি কথা বলতে পারেননি। এর পর কবিকে দেশে, দেশের বাইরে লন্ডন ও ভিয়েনায় চিকিৎসা করানো হয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো সুফল হয়নি। নজরুল এরকম অসুস্থতার ভেতরেই চিরদিনের জন্য প্রিয়তমা স্ত্রী প্রমীলাকে হারান ১৯৬২ সালের ৩০ জুন । কাজী অনিরুদ্ধ মারা যান মাত্র ৪৩ বছর বয়সে, ১৯৭২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। বাকরুদ্ধ বোধহীন যেন এক মাংসপিণ্ড নজরুল পাথর-চোখে অসহায়ের মতো শুধুই দেখেছেন প্রিয়জনদের চলে যাওয়া।
কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র ২৩ বছরে যে অসাধ্য কর্মযজ্ঞ সাধন করে গেছেন, স্বাভাবিক পন্থায় তা কখনো সম্ভবপর নয়। আবার ৩৪ বছর অর্ধমৃত হয়ে বাকরুদ্ধ মাংসপিণ্ড হয়ে যে জীবন তিনি পার করেছেন, তাও কল্পনায় আনা সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন