ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

লালন সাঁইয়ের গান : মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ উপাচার ॥  এমরান হাসান

আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৩৭ পিএম

বাউল শিরোমণি লালন ফকিরের চিন্তা ও দর্শন আজ বাংলার চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতার জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে বিদ্যমান। বাঙালি মরমীবাদ ও বাঙালি চিন্তা অর্থাৎ বাঙালিয়ানা, চিরায়ত বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক বিশাল স্থানজুড়ে যে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে জায়গা দখল করেছে, নিঃসন্দেহে সেটি মাটিবর্তী মানুষের ভাবাবেগ দর্শন এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক বিশাল মঞ্চ। 

লালন ‘ফকিরি দীক্ষা’ গ্রহণের পূর্বের বিশদ কাহিনি সর্বজনবিদিত। তার বসন্তরোগে আক্রান্ত হওয়া, অন্তর্জলি থেকে উদ্ধার হওয়া; এক মুসলমান তন্তুবায় সম্প্রদায়ের ঘরে আশ্রয় পাওয়া; তার কথিত সাধন গুরু সিরাজ সাঁইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ-এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এবং বিভিন্ন কাহিনি বাংলার মানুষের মুখে মুখে বিরাজ করছে লালন সাঁইয়ের জীবদ্দশা থেকেই। 

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—সুফি সাধক সিরাজ সাঁইয়ের কাছেই লালন আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেন। ফকির লালন সাঁইজির পরবর্তী জীবন সাধন, ভজন, মতবাদ এবং ভাবতাত্ত্বিক সংগীতের ভেতর দিয়ে কেটে গেছে। একটি কথা অনস্বীকার্য যে, লালন ফকির তার জীবদ্দশায় অসংখ্য গান রচনা করেছেন এবং গানের বাণীর আড়ালে যে অসংখ্য নিগূঢ় রহস্য রেখে গেছেন যে রহস্যগুলোর অনেকাংশই আজ অবধি সমাধান করা সম্ভব হয়নি। তিনি তার নিজস্ব মতবাদ প্রচার করে গেছেন এটি যেমন সত্য তেমনি সত্য যে, এই মতবাদ হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক চর্যাপদ অর্থাৎ বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের রেখে যাওয়া সাধনতত্ত্বের নতুন সংস্করণ। এই সুফি-বৈদ্যিক মতবাদের গভীরে লালন সাঁই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এমন এক মানবিক চিন্তার ব্যূহ যা আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও সেটি আসলে পরম দুর্ভেদ্য এক মায়াজাল। কেবলমাত্র লালন সাঁইজির শিষ্য-প্রশিষ্যরা এবং এই পথের সাধকরাই এই রহস্যের সঠিক উত্তর জানেন।

লালন সাঁইয়ের গানের চিন্তা উচ্চতর শিল্পরীতিই এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। তার বাণী ও সুরের মূর্ছনা একদিকে যেমন আপন আত্মাকে তার নিজের ঠিকুজি চিনতে সাহায্য করে অপরদিকে দিশাহারা মানুষের চিন্তা আর মোহকে কেন্দ্রিভূত করে একান্তই নিজেকে চেনার সহজ উপায় খুঁজে বের করতে।

লালন সাঁই ভাববাদী দার্শনিক। তার বাণী সর্বপ্রাণবাদকে জোরালো সমর্থন করে। পাশাপাশি তার গানের বাণী এবং সুর একেশ্বরবাদী চিন্তাকে যেমন প্রধান করে তোলে পাশাপাশি প্রধান করে তোলে অদ্ভুত সব মোহ জাগতিক চিন্তাকে।

লালন সাঁইয়ের গানগুলো ভাববাদিতা, আধ্যাত্মবাদ এবং সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিমার কারণে সহজেই কালোত্তীর্ণ হওয়ার সম্মান পেয়েছে। গানের আদলে তিনি অদ্ভুত বাতিঘর নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং শুধু এ কারণেই বর্তমান বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, সমাজ ব্যবস্থার ভেতরে লালন আপনাআপনিই লালিত হয়েছেন মনুষ্য হৃদয়ে। দেহের ভেতর আত্মার বসতি। আর এই আত্মিক সাধনার ফলেই যার দেখা মেলে তিনি অলখ সাঁই (অলক্ষ্যের স্বামী বা স্রষ্টা)। তার গানের ভেতর তিনি প্রকাশ করেছেন এসব চেতনা আর অলখের আধ্যাত্মবাদ। লালন মতবাদে টলে জীব, অটলে ঈশ্বর।

আবার তার অনেক গানেই আল্লাহ্-নবীতত্ত্ব কিংবা কৃষ্ণ-গৌড় তাত্ত্বিকতার প্রভাব মেলে প্রচণ্ডভাবে। মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়েও রূপকার্থে গানের ভণিতা করেছেন লালন। একটি কথা ¯পষ্ট করে বলা যায়, তার গানের রহস্য উন্মোচন একদিকে যেমন দুরূহ, অন্যদিকে সহজ। কেননা তার গানের মধ্যে রূপক ভাবধারাই বেশি। সহজ কথা খুব সহজে তিনি কমই এনেছেন গানের কলিতে। নিজের ভেতরে যে মানুষ, লালন বারবার তাকেই খুঁজেছেন। বিভিন্নভাবে তার চেতনায় এসেছে ‘মনের মানুষ’, ‘অচিন পাখি’ এসব শব্দের ব্যবহার। ‘আপন ঘরের খবর নে না, অনাসে দেখতে পাবি কোনখানে সাঁইর বারামখানা’ অথবা চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি, ভেদ-পরিচয় দেয় না আমার ওই খেদে ঝুরে আঁখি’ ইত্যাদি গানে এ রকম ধ্যানই প্রাধান্য পেয়েছে বারবার। দেহের ভেতর অন্য এক দেহের সন্ধান করেছেন লালন সাঁই তার গানের, হয়তো পেয়েও গেছেন আবার পেয়ে হারানোর দুঃখও প্রকাশ করেছেন তার গানে। তিনি তার গানের মাধ্যমেই প্রকাশ করেছেন জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার স্থিতি। তার আদর্শ কপিলাবস্তুর সিদ্ধার্থ, গৌতম বুদ্ধের মতোন ‘আত্মং বিদ্ধিং। যেমন হাদিসের ভাষা টেনে বলা যায়, মান আরাফা নাফসাহু ফাবা’দ আরাফা রাব্বাহু; যার অর্থ, যে নিজেকে চিনেছে সে স্রষ্টাকে চিনেছে। 

লালন চেতনায় অচিন পাখি, মানুষ রতন, অলখ সাঁই বোধকরি সেইজন। লালন সাঁইয়ের সাধনা মানবতার উদার পরিসরে এবং বিশুদ্ধ চেতনায় সমৃদ্ধ। আনাল হক্কের যে প্রতিধ্বনি উচ্চারণ করেন লালন তার গানের মূল ভাববাদিতাও সেই গুরুমুখী বিদ্যা ও ভক্তির চেতনা। লালন তার অনেক গানে এবং ধ্যান-ধারণায় সিরাজ সাঁইকে ঈশ্বরের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ তার একটি গানের শেষাংশ লক্ষ্য করলে দেখা যায় ও আদমি হইলে আদম চেনে-ঠিক নামায় সে দেল কোরানে, লালন কয় সিরাজ সাঁইর গুণে, আদম অধর ধরার সূতা’। এ গানটিতে তার দৃষ্টিভঙ্গিমা এরূপ যেন সিরাজ সাঁই স্রষ্টারূপে হৃদয় অন্দরে আসীন রয়েছেন। লালন সমসাময়িক সময়ে গুরুমুখী বিদ্যার যুগ ছিল অনেকাংশে ব্যাপক। যার কারণে গুরুমুখী ধ্যান-ধারণা তার গান এবং চেতনার সিংহভাগ জুড়েই রয়েছে। অপর একটি গানের অংশবিশেষে লক্ষ্য করলে আধ্যাত্মচেতনার মানচিত্রের ধোঁয়াশাপূর্ণ এক রূপকথা চিত্র উঠে আসে।

প্রেম, ভক্তি, কাম এ সবকিছুর কোনোটিই মানুষের ঊর্ধ্বে নয়। মানুষই পৃথিবীতে স্বর্গ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, মানুষের ধ্যান-ধারণার বহিঃপ্রকাশের কারণেই পৃথিবী চির সুন্দর হয়ে ওঠে। লালন সাঁইয়ের গানে বারবার উঠে এসেছে দেহতত্ত্বের চেতনা। নিজের সন্ধানেই লালন তার গানে বৈচিত্র্য এনেছেন, বদল করেছেন তার রূপরেখা। আধ্যাত্মচেতনা আর গুরুতাত্ত্বিক ভাবনা যা-ই থাকুক না কেন, দেহতত্ত্বের বিষয়টি তার গানে তীব্রভাবে এসেছে বারবার।

লালন সাঁই, লালন গোসাঁই, লালন ভেড়ো, অধীন লালন, বোকা লালন, সাঁই লালন ইত্যাদি শব্দের ভণিতায় লালন তার গান সাজিয়েছেন। ভণিতা বিচার নয়, বরং লালন সাঁইয়ের গানে সিরাজ সাঁইয়ের উপস্থিতি আবার লালনের নিজস্ব মতবাদ এ দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান লক্ষণীয়। একবিংশ শতাব্দীতে লালনচর্চা যখন উচ্চতর প্রসারের মাঝপথে দাঁড়িয়ে,সেই সময়ও লালন সাঁইয়ের গুরুনাম ব্যবহারের ভণিতায় মতভেদ কাটেনি পুরোপুরি। আখড়াই ঘরানার লালন চর্চা এবং একান্ত গবেষণার জন্য লালন সম্পর্কে জানার আগ্রহ মানুষের মধ্যে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আখড়াই ঘরানার অনেক বাউল মনে করেন, সিরাজ সাঁই সত্যিকার অর্থেÑ ‘সে-রাজ সাঁই’; যার অর্থ দাঁড়ায় তিনি প্রধান স্রষ্টা। যদিও গবেষকদের মন্তব্য এ মতবাদের বিপক্ষ সমর্থন করে। আরো রয়েছে কথান্তরজনিত সমস্যা। এ সমস্যাটিও বিভ্রান্ত করে লালনের গানের সঠিক ভাবনা আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে। লালন সাঁইয়ের প্রায় সবগানেরই ধুয়া, সঞ্চারীতে কথান্তরজনিত সমস্যা প্রবল।

তার গানের মতভেদ প্রচুর। লালন সাঁই ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে গেয়েছেন আত্মশুদ্ধির গান। তার গান নিয়ে বিতর্ক হয়েছে প্রচুর। তার অন্তর্ধানের ১৩২ বছর পরও জাত, কুল-মান নিয়ে রয়ে গেছে অসংখ্য গল্প; যা কেবলি জনশ্রুতি। নিরাকার ঈশ্বরের পক্ষে যেমন তিনি গান করেছেন তেমনি আবার তার গানে অবতার রূপে এসেছে মানুষ। চণ্ডীদাস যেমন বলেছিলেন মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথা, শুন হে মানুষ ভাই, সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই আবার একই কথা ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে গিয়েছেন লালন সাঁই; কিন্তু তার এই প্রকাশ আরো উচ্চতর পর্যায়ে লালন সাঁইয়ের গান স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল আলোকিত করে, আলোচিত করে বারবার সৃষ্টিকর্তা নিজের ভেতরই বসবাস করেন'-এরকম সত্যের ওপর লালন সাঁইয়ের গানের বাণীগুলো প্রতিষ্ঠিত। 

লালন সাঁই। যুগশ্রেষ্ঠ দার্শনিক, মানব জয়গানের শ্রেষ্ঠ শিল্পী, বাউল গানের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা। মানবিকতার জয়গান, মানুষের ভেতর থাকেন স্রষ্টা, এসবই তার গানের মূলবাণী। লালনের অনেক গান রয়েছে প্রেমমূলক, কৃষ্ণতাত্ত্বিক, গুরুতাত্ত্বিক এবং পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক মতবাদের ওপর। তারপরও লালন সাঁইয়ের একতারায় ঝরে পড়ে মানুষের সুর, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বন্দনা। সামান্য থেকে অসামান্যের দিকে, কেন্দ্র থেকে বৃত্তের দিকে এবং পরে বৃত্তীয় বিস্ফোরণের দিকে এগিয়েছেন লালন নিজেই। তার গানের ভেতর অন্যসব তাত্ত্বিকতাকে ছাড়িয়ে কেবলই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা এবং বন্দনা। লালন সাঁইয়ের গান মানুষতত্ত্বের শ্রেষ্ঠ আরাধনা।

আরও পড়ুন