গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে প্রায়ই গণতন্ত্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ বলা হয়। এর মূল কাজ হলো—তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া, কর্তৃত্বের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং জনগণকে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করা। কিন্তু এই স্বাধীনতার ধারণাটি আজ অত্যন্ত জটিল ও চ্যালেঞ্জিং একটি ভূদৃশ্য তৈরি করেছে, যেখানে আদর্শ ও বাস্তবতার মধ্যে বিরাট ফারাক।
স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া প্রকৃত গণতন্ত্র অচল। এটি সরকার, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও শক্তিশালী গোষ্ঠীর অপকর্ম ও দুর্নীতি উন্মোচন করে। ক্ষমতাসীনদের কাজকর্মের সমালোচনা ও তদারকির মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কথা, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও সমস্যা তুলে ধরে। সঠিক, সময়োপযোগী ও ভারসাম্যপূর্ণ তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে জনগণকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিষয়ে সচেতন ও অংশগ্রহণমূলক করে তোলে। নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো সামনে আনতে পারে।
২০২৫ সালেও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার চিত্র হতাশাজনক। দমনমূলক আইনের ব্যাপক অপব্যবহার, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা-মামলার ঢল, মালিকানার চাপ এবং ব্যাপক আত্মসংশোধনের সংস্কৃতি গণমাধ্যমকে তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখছে। রয়েছে চ্যালেঞ্জ ও নানা জটিলতা। যেমন ধরুন:
১. সরকার কর্তৃক লাইসেন্স বাতিল, বিজ্ঞাপন বন্ধ, মামলার ভয় দেখানো, এমনকি শারীরিক হামলা, আটক বা হত্যার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ‘জাতীয় নিরাপত্তা’, ‘সামাজিক সম্প্রীতি’ ইত্যাদি নামে আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। সরকারপন্থী মালিকানা, পক্ষপাতদুষ্ট নিয়োগ বা সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি করে স্বাধীন প্রতিবেদনকে ভয় দেখানো হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষে সরকারি প্রচার মাধ্যমের ব্যবহার এবং বিরোধী কণ্ঠস্বরকে ‘ভুয়া সংবাদ’ আখ্যা দিয়ে দমন করার প্রবণতা বাড়ছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) আইনটির সর্বাধিক ভয়ঙ্কর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।
আইনটির মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ, ‘আইনশৃঙ্খলার অবনতি’, ‘মিথ্যা ও আপত্তিজনক তথ্য প্রকাশ’- এর মতো অস্পষ্ট ধারাগুলো ব্যবহার করে সাংবাদিক, সম্পাদক, কার্টুনিস্ট এমনকি সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই ডিএসএ-এর আওতায় কমপক্ষে ৫০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের খবর পাওয়া গেছে (সূত্র: বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন -বিএফইউজে, জুলাই ২০২৫ এর প্রেস রিলিজ; মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র - ASK এর ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন)।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০২৫ এর একটি রিপোর্টে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অপব্যবহার’, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার ঢল’ এবং ‘সরকার সমর্থকদের দ্বারা অনলাইন ও প্রিন্ট হুমকি’কে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৫তম অবস্থানে রয়েছে (সূত্র: আরএসএফ ওয়েবসাইট, জুন ২০২৫ রিপোর্ট)।
২. কয়েকটি ধনকুবেরের হাতে গণমাধ্যমের মালিকানা কুক্ষিগত হওয়ায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সংবাদের চেয়ে মুনাফা অগ্রাধিকার পায়। ডিজিটাল যুগে প্রচলিত মিডিয়ার আয় (বিশেষ করে বিজ্ঞাপন) কমে যায়। ফলে সংবাদের গুণগত মান কমে, সাংবাদিক ছাঁটাই হয়। একই সঙ্গে দ্রুত, চটকদার খবরের দিকে ঝোঁক বাড়ে। বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরতা তাদের সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
৩. প্রচলিত মিডিয়ার একচেটিয়া কর্তৃত্ব ভেঙে দিলেও এটি ভুয়া সংবাদ, অপপ্রচার ও চরমপন্থী মতাদর্শ ছড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। সত্য যাচাই (Fact-checking) জটিল হয়ে পড়েছে। সাংবাদিক ও মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ, তথ্য-উপাত্ত হ্যাকিং বা সরকারি নজরদারির শিকার হচ্ছে।
৪. নারী সাংবাদিকরা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংবাদিকরা অনলাইনে ব্যাপক হয়রানি, হুমকি ও অপপ্রচারের শিকার হন। ‘ফেক নিউজ’ এর বিশ্বাসযোগ্যতা সংকট : ভুয়া সংবাদের ব্যাপক বিস্তার গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে, যা সার্বিকভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও প্রভাবকে দুর্বল করছে। কিছু বিষয়ে প্রতিবেদন করাকে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক অনুভূতিতে আঘাত হিসেবে দেখা হয়, ফলে সাংবাদিকদের ওপর সমাজের কিছু অংশ থেকে চাপ ও হুমকি আসে।
৫. সাধারণ মানুষ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন করছে। এটি স্বাধীনতার মাত্রা বাড়ালেও তথ্যের সত্যতা, ভারসাম্য ও পেশাদার নৈতিকতা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
এত জটিলতার সত্ত্বেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা ও জোরদার করার জন্য কিছু পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। সংবিধানে স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া এবং সাংবাদিকদের সুরক্ষা, তথ্যের অধিকার (RTI) ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কার্যকরভাবে রক্ষাকারী আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব নৈতিক কোড শক্তিশালী করতে হবে এবং স্বাধীন প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমের মালিকানার বৈচিত্র্য আনয়ন এবং কমিউনিটি রেডিও, অলাভজনক সাংবাদিকতা বা ক্রাউডফান্ডিংয়ের মতো বিকল্প অর্থায়ন মডেলকে উৎসাহিত করতে হবে। অনলাইন গোপনীয়তা, নিরাপত্তা এবং সেন্সরশিপমুক্ত ইন্টারনেটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও হয়রানির মামলাগুলোর দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কোনো স্থির বা সহজসাধ্য বিষয় নয়; এটি একটি নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ক্ষেত্র। রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও সমাজের জটিল মিথস্ক্রিয়ায় এটি ক্রমাগত নতুন রূপ ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জিং ল্যান্ডস্কেপে সত্যিকার স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে কেবল আইন বা প্রতিষ্ঠানই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সচেতন ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ, পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতায় বলীয়ান সাংবাদিকতা এবং সর্বোপরি, একটি সংস্কৃতি যা সমালোচনা, জবাবদিহিতা ও তথ্যের অবাধ প্রবাহকে গণতন্ত্রের অপরিহার্য ভিত্তি হিসেবে মূল্যায়ন করে। জটিলতা স্বীকার করেই এই স্বাধীনতার মূল্য বোঝা এবং তার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া– এটাই বর্তমান সময়ের অপরিহার্য দাবি।
