চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে ২০২৬ সাল কেবল একটি নতুন বছরের সূচনা নয়, বরং এটি একটি জাতিরাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লব ক্ষমতার পালাবদল ঘটালেও রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা ক্ষতগুলো সারিয়ে তোলাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
নতুন এই বছরে বাংলাদেশকে মূলত পাঁচটি প্রধান ফ্রন্টে লড়াই করতে হবে: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, তরুণদের কর্মসংস্থান এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি।
১. সংস্কার বনাম নির্বাচন: ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ
বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিতর্ক হলো—আগে সংস্কার নাকি আগে নির্বাচন? রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিটি এখন গণ-আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা অপরিহার্য।
* ঝুঁকি: সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বিত হলে সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
* বিপরীত ঝুঁকি: আবার সংস্কারহীন তড়িঘড়ি নির্বাচন পুরনো ‘স্বৈরাচারী কাঠামো’কেই ভিন্ন নামে ফিরিয়ে আনতে পারে। এই দুই চাপের মাঝে একটি গ্রহণযোগ্য ‘রোডম্যাপ’ তৈরি করাই হবে নতুন বছরের প্রধান রাজনৈতিক পরীক্ষা।
২. অর্থনীতির ক্ষত ও জনজীবনের টানাপোড়েন
রাষ্ট্রের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা মূলত নির্ভর করছে বাজারের ব্যাগের ওপর। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষকে দিশেহারা করে তুলেছে।
* ব্যাংকিং খাত: বিগত সময়ের লুটপাট ও খেলাপি ঋণের বোঝা কাটিয়ে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো এখন সময়ের দাবি।
* বৈদেশিক চাপ: ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ অর্থনীতিকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে। এই সংকট উত্তরণে কেবল নীতি নয়, দরকার কঠোর রাজনৈতিক সংকল্প।
৩. তরুণ প্রজন্ম: সম্ভাবনা নাকি আগ্নেয়গিরি?
বিপ্লবের অগ্রনায়ক তরুণ সমাজ এখন কর্মসংস্থান ও গুণগত পরিবর্তনের অপেক্ষায়। উচ্চশিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা না গেলে রাজপথের এই ‘আশার শক্তি’ দ্রুতই ‘হতাশার আগুনে’ রূপ নিতে পারে। রাষ্ট্রকে কেবল স্লোগানে নয়, বরং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তরুণদের অংশগ্রহণ ও মেধার মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৪. কূটনীতির কঠিন দাবার চাল
নতুন বছরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হবে এক জটিল ভারসাম্যের খেলা।
* আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তি: ভারত, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিভুজাকার স্বার্থের কেন্দ্রে এখন বাংলাদেশ।
* মানবাধিকার ও নির্বাচন: পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে চাপ বাড়বে। অন্যদিকে, ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং চীনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ভারসাম্য রক্ষা করা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য একটি বড় পরীক্ষা।
৫. তথ্যযুদ্ধ ও সামাজিক মেরুকরণ
প্রযুক্তির এই যুগে গুজব এবং প্রপাগান্ডা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্টের বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল তথ্য ছড়িয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা প্রতিহত করা এবং একইসাথে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা—এই দুইয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম রেখা টানা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
উপসংহার: একটি নতুন 'রাষ্ট্রচুক্তি'র আহ্বান
২০২৬ সালে বাংলাদেশের সাফল্য কেবল জিডিপি বা নির্বাচনের আয়োজনে সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃত সাফল্য আসবে তখনই, যখন নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। জুলাই বিপ্লব যে সুযোগ তৈরি করেছে, তা কাজে লাগিয়ে একটি নতুন 'রাষ্ট্রচুক্তি' প্রয়োজন—যেখানে রাষ্ট্র হবে জনগণের সেবক, কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতিয়ার নয়।
নতুন এই বছরে বাংলাদেশ কি ভয় কাটিয়ে ভরসার প্রতীক হতে পারবে? উত্তরটি নির্ভর করছে বর্তমান নেতৃত্বের সাহসী সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের ওপর।
ইংরেজি নতুন বর্ষ ২০২৬ শুরু 