ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

ডেমু ট্রেনের ৬৫০ কোটি টাকার পুরোটাই জলে

আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩০ পিএম

স্বপ্নের অত্যাধুনিক ডিজেল মালটিপল ইউনিট (ডেমু) প্রকল্পের ব্যর্থতার দায় নিচ্ছে না রেলের কেউ। প্রকল্পটি অনুমোদন, দরপত্র প্রক্রিয়া, ক্রয় প্রক্রিয়া এসবের প্রায় প্রতিটি ধাপে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা ২০ সেট ডেমু শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ে।

৩৫ বছর মেয়াদ থাকলেও প্রথম ২ বছর থেকেই অকেজো হওয়া শুরু। এখন কোনো অবস্থাতেই এগুলো মেরামত করা সম্ভব নয়। ডেমুর মালামাল স্থানীয়ভাবে কোথাও পাওয়া যায় না। চীন এগুলোকে একটি বিশেষ সফটওয়্যার দিয়ে চালাত। সেই সফটওয়্যারও নেই। যে কদিন ট্রেনগুলো চলাচল করেছে সে সময় মেরামতের পেছনে অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে লোকসান হয়েছে আরও প্রায় ৩০ কোটি টাকা। সব মিলে ডেমু ট্রেনের পেছনে সরকারের ৬৫০ কোটি টাকার পুরোটাই জলে গেছে।

২০১৩ সালে নেওয়া প্রকল্পের পিডিসহ সংশ্লিষ্ট বেশকিছু কর্মকর্তা অবসরে গেছেন। প্রকল্প তৈরির সময় রেলের মহাপরিচালক এবং তার পরের মহাপরিচালকও অবসরে। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী এবং পরিকল্পনামন্ত্রী মারা গেছেন। কিছু কর্মকর্তা এখন চাকরিতে থাকলেও তাদের কেউ দায় নিচ্ছেন না।

এছাড়া বর্তমানে যারা দায়িত্বে আছেন তারা বলছেন প্রকল্প গ্রহণ ক্রয়সহ এ সংক্রান্ত কাজের সময় তারা ছিলেন না। কেনার সময় অতি আগ্রহ এবং পরে যে কোনোভাবে দায় এড়ানোয় ডেমু প্রকল্পের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। এখন ট্রেনগুলো নিলামে বিক্রি করে দেওয়ার পাঁয়তারাও চলছে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে শনিবার (২৭ এপ্রিল) সন্ধ্যায় রেলপথমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিল্লুল হাকিম গণমাধ্যমকে জানান, ডেমু ট্রেন নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। তবে ট্রেনগুলো আমি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কেনা হয়নি। যে মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার সময়ে ট্রেনগুলো কেনা হয়েছে তিনি আর নেই। তাছাড়া ডেমু কেনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কারা ছিলেন- সেটা আমার জানা নেই। কেনাকাটা এবং ডেমু প্রশিক্ষণে বিদেশে যেসব কর্মকর্তা গিয়েছিলেন, তাদের বিষয়েও আমি জানি না। তবে জবাবদিহি থাকা প্রয়োজন। এখন অকেজো ডেমুগুলোর কি হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ডেমু বিষয়ে আমি খুব একটা জানি না। তবে এ বিষয়ে আমি খোঁজ নেব।

দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা বলেন, ডেমুগুলো বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে। অবশিষ্ট ১২টি ডেমু চট্টগ্রাম এবং লালমনিরহাট শেডে পড়ে আছে। একটি মাত্র ডেমু চট্টগ্রাম দোহাজারী রুটে চলছে। সেও একদিন চলে এরপর ৪ দিন বন্ধ হয়ে থাকে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

রেলপথ সচিব ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, এখন ডেমু সেভাবে চলছে না। এটি যাত্রীবান্ধব হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা সমস্যার কারণে তা হয়নি। এছাড়া ডেমু ক্রয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিল, তাদের অবস্থান আমার জানা নেই। এ প্রকল্পে যারা বিদেশে গিয়েছিলেন, নিশ্চয় তাদের জবাবদিহিতা থাকবে। জবাবদিহি থাকা প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, রেলে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়নের সুফল যাতে সাধারণ মানুষ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। ডেমুর মতো ট্রেনগুলো সচল থাকলে কম দূরত্বের রেলওয়ে স্টেশনগুলোতে পর্যাপ্ত ট্রিপ দেওয়া যেত। এদিকে অকেজো ডেমু ট্রেনের বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট হাতে এসেছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা হয়েছে গত বছরের ১১ মে। 

তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশে বলা হয়, ডেমু কিছুতেই মেরামত করা সম্ভব নয়। এতে ব্যবহৃত মডিউল, সেন্সর আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ না হলে মেরামত হবে না। চীনা ঠিকাদারি কোম্পানির কাছ থেকেই শুধু ওই সব যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করতে হবে, কারণ ওই সব যন্ত্রপাতি শুধু তারাই দিতে পারবে। এ বিষয়ে চীনের সিআরআরসিকে আহ্বান করা যেতে পারে। সুপারিশে আরও বলা হয়, ডেমু মেরামত বিষয়ে রেলওয়ের পরিপূর্ণ কারিগরি সক্ষমতা গড় উঠেনি। এ জন্য ডেমু বিষয়ে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন পরামর্শক জরুরি। কমিটির এক সদস্য বলেন, ডেমু ক্রয় থেকে দেশে চলাচল শুরু পর্যন্ত পুরো সময়েই অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্য দিয়ে গেছে। পুরো অর্থটাই জলে গেছে।

সূত্র জানায়, ডেমু কিনতে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করে ৮ কর্মকর্তাকে চীনে পাঠানো হয়েছিল। তাদের দায়িত্ব ছিল ডেমুর কার্যকারিতা ও অন্যান্য বিষয় দেখে আসা। এদের মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে বিভাগের ৬ কর্মকর্তা এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ও পরিকল্পনা কমিশনের একজন করে কর্মকর্তা ছিলেন। রেলের এক কর্মকর্তা বলেন, এরা প্রায় দেড় মাস চীনে অবস্থান করেন। ফেরার সময় ব্যাগভর্তি শপিং করে এসেছেন।

পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম সামছুল হক বলেন, ডেমু ক্রয় পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বিদেশে যাওয়া কর্মকর্তা এবং বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এর দায় এড়াতে পারেন না। সরকারি অর্থ মানেই সাধারণ জনগণের অর্থ। ৬৫০ কোটি টাকা একেবারেই কাজে এলো না। এ জন্য প্ল্যানিং কমিশন থেকে শুরু করে রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এ প্রকল্পে জড়িতদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত। দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়া দরকার। তাহলে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে এমন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সবাই সতর্ক থাকবে।

HR/FI
আরও পড়ুন