রেলগাড়ি ঝমাঝম পা ফসকে আলুর দম, সেই অবস্থা থেকে রেলকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি। যদিও বদলেছে রেলের গতি প্রকৃতি। যেমন আগের কয়লার ইঞ্জিনের জায়গায় ডিজেল ইঞ্জিন, এরপর সেটি বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনে পরিবর্তিত হওয়া। কিন্তু গণমানুষের বাহন হয়ে উঠতে পারেনি ট্রেন বা রেলগাড়ি। কেবলই দিন বদলের খোয়াব দেখানো হয়েছে ফলে অপচয় হয়েছে সময় আর যেখানে কেবলই টাকার শ্রাদ্ধ।
রেলের ওপর পড়া শনির কালো হাত কোনোভাবেই দুর হচ্ছে না। রেলের কালো বিড়ালের কারণে দিনকে দিন গণমানুষের কাঙ্ক্ষিত পরিবহনটি অনেকটাই ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। বিগত ও বর্তমান সরকার নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা স্বস্তি দিতে পারেনি এই সেবা খাতকে। যার পিছনে দায় সীমাহীন দুর্নীতি আর অনিয়মের পসরা। এমনটিই মনে করেন রেল পরামর্শকরা।
তারা মনে করেন, দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে রেলের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন আটকে আছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতাও নিজেদের পকেট ভরার বাতিক।
এদিকে অনিয়মের বেড়াজালে পড়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে ট্রেন দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছেন যাত্রীরা, ফলে ট্রেন যাত্রায় এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। অন্যদিকে নতুন ডিজেল-ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট-ডিইএমইউ (ডেমু) ট্রেন নিয়ে বিপাকে পড়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। ডেমু ট্রেন নিয়ে সংকট যাত্রীদের সুবিধার জন্য এ কমিউটার ট্রেন নামানো হলেও এখন তা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চীন থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনা হয়। ৩০ বছর সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও দশ বছরের মাথায় ডেমু ট্রেন ভাঙারি হিসেবে বিক্রির পরিকল্পনা চলছে। নষ্ট ডেমুগুলো মেরামতের সক্ষমতা না থাকায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপযোগিতা না থাকলেও ব্যক্তি লাভের আশায় নেয়া হয়েছিল এ প্রকল্প। রেলে এ রকম প্রকল্প আরও আছে জানিয়ে জড়িতদের শাস্তি দাবি তাদের।
সরেজমিনে কমলাপুরে গিয়ে দেখা যায়, যেন ট্রেনের ভাগাড়। ঘন জঙ্গলে খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে একেকটি। দেখতে নতুন হলেও খসে পড়েছে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। খুবই নাজুক অবস্থা ডেমু ট্রেনের।
নতুন এ প্রযুক্তি নিয়ে ধারণা না থাকায় মেরামত করতে ব্যর্থ হন মেকানিকরা। মাঝে মধ্যে সচল হলেও ৩ বছর আগে স্থায়ীভাবে বিকল হয়ে গেছে ২০টি ডেমু ট্রেনই। অথচ এ অর্থে ১০টি ইঞ্জিন ও ১২০টি কোচ কেনা সম্ভব ছিল। যাতে নতুন ১০টি ট্রেন পরিচালনা করা যেত। এছাড়া ডেমু ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি সাধারণ ট্রেনের তুলনায় অনেক হালকা ও কম টেকসই বলে রেলওয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান। তারা বলেছেন, রেলওয়ের কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা ছাড়া রেল উন্নয়ন সম্ভব নয়। ঈদকে সামনে রেখে ট্রেন শিডিউল ভেঙে পড়লে অবাক হবার মতো কোন কারণ থাকবে না।

রেল দুর্ঘটনা :
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, চেকআপবিহীন ট্রেন চলাচল ও জনবল সংকটের কারণে গত সাড়ে পাঁচ বছরে ১ হাজার ৪০০ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৩০ জন।
গবেষকরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকায় প্রতিরোধযোগ্য এসব দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। আর রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, দুর্ঘটনারোধে রেলের অনেক বিধিবিধান রয়েছে, সেগুলো মানা হয় না বলেই বাড়ছে দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় চরম বিড়ম্বনায় পড়ছেন ট্রেন যাত্রীরা। বিপর্যয় দেখা দিয়েছে ট্রেনের শিডিউলে। সারাদেশে ২ হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার রেলপথের অনুমোদিত ১ হাজার ৪১২টি ও অননুমোদিত ১ হাজার ৮৩টি অর্থাৎ মোট ২ হাজার ৪৯৫টি রেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২৫৯টিতে গেটম্যান আছে। বাকি ২ হাজার ২৩৬টিতে কোনো গেটম্যান নেই।
জানা গেছে, রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান প্রকৌশলীর অধীনে পিডব্লিউআই (পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর), এপিডব্লিউআই (অ্যাসিস্ট্যান্ট পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর), মিস্ত্রি, চাবিম্যানসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত থাকেন। প্রতিটি ট্রেন ছাড়ার ১০ মিনিট আগে রেলপথ চেকআপ করার কথা থাকলেও সেটা করা হয় না। যার খেসারত দিচ্ছে ট্রেন আর তার হতভাগ্য যাত্রীরা।
এদিকে দিন দিন ট্রেন দুর্ঘটনা বাড়ায় মানুষের আস্থা হারাচ্ছে পরিবহণ খাতের সবচেয়ে আরামদায়ক এই সেক্টরটি। পিডব্লিউআই সপ্তাহে একদিন এবং এপিডব্লিউআই সপ্তাহে তিনদিন এলাকাভিত্তিক রেলপথ পরিদর্শন করার কথা থাকলেও তারা তা না করেই রেলকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছেন।
অন্যদিকে মিস্ত্রির প্রতিদিন লাইন চেক করার এবং চাবিম্যানের প্রতিদিন লাইনের চাবি, ওয়াশার, নাট-বল্টু চেক করার কথা থাকলেও তারা করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
রেলের উন্নয়নে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা করে রেল মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যাত্রা শুরুর পর দায়িত্ব পান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। দায়িত্ব পাওয়ার পরই তিনি দুর্বল রেল ব্যবস্থার অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা কালো বিড়াল খুঁজে বের করার ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেই তার খেসারত দেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী এ মন্ত্রী পাঁচ মাস না পেরুতেই অর্থ কেলেঙ্কারির বোঝা মাথায় নিয়ে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। এরপর দায়িত্ব দেয়া হয় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে। তার দৃশ্যমান তৎপরতায় পরের দিনগুলোতেও আলোচনায় থাকে এ মন্ত্রণালয়।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠিত হয়। ২০১২ সালে ৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সরকারের মেয়াদ তিন বছর পূর্ণ হওয়ার ১৩ মাস বাকি থাকতে আলোচিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের এমপি মুজিবুল হক। তিনি রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই অঙ্গীকার করেন, রেলে এখন থেকে কোনো দুর্নীতি হবে না, শেষ সময়ে কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন এমন নানা প্রতিশ্রুতি দেন।
এর পর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান মো. নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি শপথ নেন। তিনিও রেলের উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর ছাত্র-আন্দোলনের পর গত আগস্টে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন রেলওয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এসব কেবলই কথার কথা রয়ে গেছে।
সাধের ডেম্যুট্রেন :
রেল কর্তৃপক্ষ ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নিম্নমানের ডেমু ট্রেন যা বেকায়দায় ফেলেছে রুগ্ণ রেলওয়েকে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে রেলের উন্নয়নে চার শতাধিক প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার হরিলুট হয়েছে। শুধু রেলকে সাজিয়ে-গুছিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়ে নেয়া হয়েছে একের পর এক নানা পরিকল্পনা। এসব প্রকল্প ভবিষ্যতে কতটুকু বাস্তবসম্মত হবে সেদিকে লক্ষ্য না রেখে শুধু পরিকল্পনার সম্ভাব্যতা যাচাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর প্রকল্প কাজের নামে খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় দু’লাখ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদন ও বাজেট বরাদ্দ পাওয়ার পরই থেমে গেছে সব দৌড়ঝাঁপ। অসাধু রেল কর্মকর্তা, কথিত কর্মচারী নেতা আর ঠিকাদাররা মিলে প্রকল্পের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছেন, নিজেরাই বনে গেছেন কোটিপতি।
যা বলছেন রেল বিশেষজ্ঞরা :
রেল বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ইতঃপূর্বেও সরকার নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। কিন্তু অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাট আর নানামুখী সমস্যায় সব উদ্যোগই ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে লাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যদিও ১৯৮২ সালের আগে রেলওয়ের বোর্ড চালু থাকা অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে ছিল না। রেলের ইনফরমেশন বুকের ২০০৫ তথ্যানুযায়ী ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রেল বিভাগ লাভজনক প্রতিষ্ঠানে ছিল। ১৯৯৯ সালে ১৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা মুনাফা করে। ২০০০ সাল থেকে পরিকল্পিতভাবে এক লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়।
রেল বিশেষজ্ঞরা বলেছেন- বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ডিএফআইডিসহ বিভিন্ন দাতাসংস্থার পরামর্শে রেল খাত ক্রমেই নানা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
এ সম্পর্কে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো সাড়া দেন নি।
তবে গত ৯ মার্চ রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের বলেন, ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন, প্রতিটি বাস টার্মিনাল ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হবে। এর মাধ্যমে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে।
এদিকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম, রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেনসহ রেলওয়ের শীর্ষ কোনো কর্মকর্তাই এ বিষয়ে সাড়া দেন নাই। তবে অতীতের মন্ত্রীদের মতো বর্তমান উপদেষ্টা রেল উন্নয়ন ও যাত্রী সেবা বৃদ্ধির অঙ্গীকারের কথা বলেন। তিনি অতীতের দুর্নীতি নিয়ে কিছু বলতে চান না। আগে কী দুর্নীতি হয়েছে না হয়েছে তা সবাই জানে। এখন থেকে রেলে আর কোনো দুর্নীতি হবে না। কোনো দুর্নীতিকে তিনি প্রশ্রয় দেবেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলের শীর্ষক এক কর্মকর্তা বলেছেন, রেলওয়ের কর্মকর্তাদের আন্তরিক ছাড়া রেল উন্নয়ন সম্ভব নয়। সৎ কর্মকর্তাগনই রেলসেবা বাড়াতে পারে। পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান হতে হবে। তবেই রেল উন্নয়ন সম্ভব।
