ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন

গণ গ্রেপ্তার বন্ধ ও র‍্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ

২০০৪ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) গঠন করা হয়েছিল। এরপর যেসব সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তারা এই বাহিনীকে দায়মুক্তি দিয়ে কাজ করার অনুমতি দেয়, বাহিনীটি ডেথ স্কোয়াডের মতো কাজ করতো।

আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:০৯ পিএম

বাংলাদেশে স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তার ও প্রতিশোধমূলক সহিংসতা বন্ধ করা, র‍্যাবের বিলুপ্তি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে কিছু সুপারিশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ৫০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

'আফটার দ্য মুনসুন রেভল্যুশন: আ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক এ প্রতিবেদনে অন্তর্বর্তী সরকারকে আটকের ক্ষেত্রে আইন অনুসরণ ও সমালোচকদের দমনের জন্য ব্যবহৃত আইন বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।

সংস্কারের ক্ষেত্রে ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং জনপ্রশাসন, পুলিশ, সামরিক, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশে স্থায়ী সংস্কার নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক যে সহিংসতা তৈরি হয়েছিল, গত বছরের আগস্টে গণবিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর তাতে একটি স্থায়ী সংস্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সমর্থনকে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাগত জানানো উচিত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়ার পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে, শুরু হয়েছে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের। বাংলাদেশে একটি অধিকার ও সম্মানজনক ভবিষ্যত গড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ভবিষ্যতের সরকারের যেকোনো দমন পীড়নকে প্রতিহত করতে দ্রুত ও কাঠামাগত সংস্কার করতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের কষ্টে অর্জিত অগ্রগতি সফল হবে না বলে উল্লেখ করেছেন পিয়ারসন।

মার্চ মাসে অনুষ্ঠিতব্য মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশনে একটি ঐকমত্য প্রস্তাব আনতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

যাতে সংস্কার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার জন্য জাতিসংঘের অব্যাহত পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন নিশ্চিত করা যায় এবং সরকারকে মূল কাঠামোগত সংস্কারের ওপর জোর দেয়া উচিত বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তা এখানে তুলে ধরা হলো...

গণ গ্রেপ্তার বন্ধে গাইড লাইন
শেখ হাসিনার সরকারের আমলে বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো প্রায়ই হাসিনার প্রশাসনের সমালোচকদের গণহারে গ্রেপ্তার করতো।

২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে হাজার হাজার বিএনপি নেতা-কর্মীদের 'মিথ্যা ও বানোয়াট' মামলায় গ্রেপ্তার করেছিল।বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা এসব মামলার আসামিদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন মৃত, বিদেশে অথবা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

এগুলোর অনেক মামলায় ব্যাপক সংখ্যক আসামি অজ্ঞাতনামা ছিল কিন্তু বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে এসব মামলায় গ্রেপ্তার পরোয়ানা জারি করা হতো। যা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক হয়রানি এবং ভয় দেখানোর সামিল। ‘অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ এখন একই ধরনের অভিযোগ করছে।’

আওয়ামী লীগের সমর্থক বা সাংবাদিক বা অন্যদের বিরুদ্ধে যারা শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহারে মামলা করা হচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ।

অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং গণহারে গ্রেপ্তার নিষিদ্ধে পুলিশের জন্য একটি গাইড লাইন অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি করা উচিত বলে সুপারিশ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

একইসঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়কে সমালোচকদের দমনে ব্যবহৃত আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া 'আটক' সংক্রান্ত যত মামলা রয়েছে সেগুলোর বিচার রিভিউ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। আটক যে কোন ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত ও দ্রুত বিচারকের সামনে হাজির করার বিষয়েও সুপারিশ করা হয়েছে।

বিচার বহির্ভূত হত্যা, ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ
গত ১৫ বছরে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ সমস্ত ক্ষেত্রে ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের মুখোমুখি করার ঘটনা নেই বললেই চলে।

তদন্তের সময় সঠিকভাবে প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান ইটস ওয়াচ।

একইসঙ্গে তদন্তকালীন সময়ে বেআইনি মৃত্যু ঠেকাতে প্রয়োজনে মিনেসোটা প্রটোকল অনুসরণ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে সুপারিশ করা হয়েছে।

'ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ড' এর স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের প্রযুক্তিগত সহায়তায় একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সুপারিশ করেছে এই মানবাধিকার সংস্থাটি।

যেসব কর্মকর্তারা এসব বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে- জনসম্মুখে এ ঘোষণা দিতেও আহ্বান করেছে সংস্থাটি।

র‍্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ
২০০৪ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) গঠন করা হয়েছিল। এরপর যেসব সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তারা এই বাহিনীকে দায়মুক্তি দিয়ে কাজ করার অনুমতি দেয়, বাহিনীটি ডেথ স্কোয়াডের মতো কাজ করতো।

র‍্যাবের একজন কর্মকর্তা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, গুম, হত্যা অথবা ক্রসফায়ারের ঘটনার জন্য র‍্যাবের আলাদা একটি দল রয়েছে। বেশির ভাগ কাজই ওই দল করে।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালে যখন র‍্যাবে যোগদান করি তখন হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের ট্রেনিং এ একজন কর্মকর্তা ক্লাস নিয়েছিলেন তার নাম আমার মনে নাই। তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন ১৬৯টি ক্রসফায়ার তিনি পরিচালনা করেছেন।

ক্ষমতার বাইরে থাকলে রাজনৈতিক নেতারা র‍্যাব বিলুপ্তির বিষয়ে একমত পোষণ করেন। র‍্যাবের বিরুদ্ধে এ ধরনের সমালোচনার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্য তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া বন্ধ করে দেয়।

২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার র‍্যাবেের পাশাপাশি বাহিনীটির সাত জন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তাতে র‍্যাবকে বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে।

প্রতিবেদনের সত্যতা স্বীকার করে র‍্যাবের প্রধান এ কে এম শহীদুর রহমান বাহিনীটির গোপন আটক কেন্দ্রের কথা স্বীকার করেন।

তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার বাহিনীটি বিলুপ্ত করে দিতে চাইলে র‍্যাব তা মেনে নেবে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সুপারিশ করেছে যে, শুধুমাত্র এই শর্তেই বিলুপ্ত করা হবে যে ‘র‍্যাবের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা অন্য বাহিনীতে গিয়ে একই ধরনের অপকর্মের চর্চা করতে পারবে না।’

একইসঙ্গে এই বার্তাও দিতে হবে যে, বাহিনীটিকে ভবিষ্যতে অপব্যবহার করা হবে না এবং পরবর্তী সরকারের দমন পীড়ন চালানোর হাতিয়ার হবে না বাহিনীটি।

বলপূর্বক অপহরণ ও গুম বন্ধের সুপারিশ
শেখ হাসিনার শাসনামলের হলমার্ক ছিল বলপূর্বক অপহরণ ও গুম। যদিও এ বিষয়টি বারবার অস্বীকার করেছে তার সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জাতীয় তদন্ত কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকারের র‍্যাব বিলুপ্তি করা উচিত বলে সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে গোপন আটকের স্থানগুলো চিহ্নিত করা এবং প্রমাণ নষ্ট না করার নির্দেশ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

আটকের সব পরিচিত স্থানগুলোর তালিকা প্রকাশ করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে গোপনে কথা বলার ক্ষমতা দিতেও সুপারিশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।অন্তর্বর্তী সরকারের বেআইনিভাবে আটক ব্যক্তিদের অবিলম্বে মুক্তি নিশ্চিত করা উচিত বলে মনে করছে সংস্থাটি।

হেফাজতে নিহত ব্যক্তি এবং কবর স্থানের সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দিতে আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনটি।

বাংলাদেশে আইনের অধীনে একটি স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে 'বলপূর্বক গুম' নিষিদ্ধ করতে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতি সুপারিশ করা হয়েছে।

AHA
আরও পড়ুন