পুলিশের সাবেক কর্মকর্তারা মনে করেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের মতো ভিভিআইপির দেশত্যাগের ঘটনা ‘ঊর্ধ্বতনরা জানতেন’। গ্রিন সিগন্যাল পেয়েই জুনিয়র কর্মকর্তা বা সদস্যরা তার ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন এবং দেশত্যাগের সুযোগ দেন। অথচ সমালোচনার মুখে পুলিশের ‘অধস্তন সদস্যদের’ শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এখানে কারো না কারো সহযোগিতা-যোগসাজশ ছিল। পরিস্থিতি না বুঝেই বক্তব্য দেওয়া এবং পরে সমালোচনার মুখে অধস্তনদের শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি ‘রোগ না বুঝে চিকিৎসা’ দেওয়ার মতো।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের নয় মাস পর গত ৭ মে দিবাগত রাত ৩টা ৫ মিনিটে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে দেশত্যাগ করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। তার বিরুদ্ধে হামলা ও সহিংসতার ঘটনায় গত ১৪ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ সদর থানায় একটি মামলা দায়ের হয়।
ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, আব্দুল হামিদের দেশত্যাগে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় তাকে ‘চিকিৎসার জন্য’ যেতে দেওয়া হয়েছে। দুজন আত্মীয় তার সঙ্গে ছিলেন। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একাধিক কর্মকর্তা তথ্যটি নিশ্চিত করেন যে, বিদেশযাত্রায় আদালতের নিষেধাজ্ঞা না থাকায় তাকে যেতে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এমন বক্তব্য প্রচারসহ আব্দুল হামিদের বিদেশ যাত্রার বিষয়টি চাউর হওয়ার পর চাপে পড়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও পুলিশ প্রশাসন। চাপের মুখে দায়িত্বে গাফিলতির অভিযোগে ওইদিন সন্ধ্যায় দুই কর্মকর্তাসহ চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানায় পুলিশ সদরদপ্তর। এর মধ্যে দুজনকে প্রত্যাহার করা হয়, আর দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
প্রত্যাহার করা সদস্যরা হলেন- ওই রাতে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বপালন করা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহসিনা আরিফ ও কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী। সাময়িক বরখাস্ত করা হয় কিশোরগঞ্জের সদর থানায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আজহারুল ইসলাম ও পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) টিএসআই মো. সোলায়মানকে।
ওই ঘটনায় গঠিত পুলিশের তদন্ত কমিটি সোমবার (১২ মে) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করেছে। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। অতিরিক্ত আইজিপি (অ্যাডমিন) মতিউর রহমান শেখের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির বাকি দুই সদস্য হলেন- এসবির ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান ও ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ডিবি-দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম।
এদিকে, আব্দুল হামিদের দেশত্যাগের পর ৮ মে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম লেখেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি ফ্যাসিস্ট ও খুনি আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে টালবাহানা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল ও নিষিদ্ধের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। আসামিদের জামিন দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অবৈধ ফ্যাসিস্ট সরকারের রাষ্ট্রপতিকে চোখের সামনে পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে। বিচার প্রশ্নে সরকারের প্রতি আমাদের অনাস্থার জায়গা তৈরি হইছে। জুলাইয়ে আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিল খুনিদের বিচার এবং মুজিববাদীরা বাংলার মাটিতে আর কখনো রাজনীতি করতে পারবে না।
তিনি আরো লেখেন, আজ রাতেই ফয়সালা হবে আওয়ামী লীগের বিষয়ে। আওয়ামী লীগের বিচার, নিবন্ধন বাতিল ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না আসা পর্যন্ত আমরা রাজপথ থেকে উঠব না।
দুদিনের আন্দোলনের মাথায় গত শনিবার (১০ মে) রাতে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানানো হয়, আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ-সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সোমবার (১২ মে) বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।
অন্যদিকে, বিমানবন্দর দিয়ে আবদুল হামিদ কীভাবে দেশ ছাড়লেন তা পর্যালোচনায় তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সি আর আবরারের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন- পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং নৌ-পরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন।
কমিটির কাজের পরিধিতে বলা হয়েছে, কমিটি সাবেক রাষ্ট্রপতির বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে তিনি কীভাবে বিমানবন্দর দিয়ে গেলেন তা পরীক্ষা করবে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালনে কোনো গাফিলতি বা ব্যত্যয় হয়েছে কি না, তাও খুঁজে বের করবে কমিটি। যারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, সেই সুপারিশও করবে কমিটি। তদন্ত কাজে কমিটি প্রয়োজনীয় দলিলপত্র, যন্ত্রপাতি ও প্রমাণ চাইতে পারবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে। সব সংস্থা কমিটির নির্দেশনা পালন ও সহায়তা দিতে বাধ্য থাকবে। কমিটি ইচ্ছা করলে অতিরিক্ত সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে।
গত ১০ মে দিনাজপুরে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার আগমন ঘিরে বিক্ষোভ শুরু করেন জুলাই আন্দোলনকারীরা। সেখানে বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে দেশ ছাড়তে যারা সহযোগিতা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে আমিই চলে যাব।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ গণমাধ্যমকে বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে এবং সরকারের পক্ষ থেকে আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে নিশ্চয়ই বিষয়টি স্পষ্ট হবে কাদের যোগসাজশ কিংবা সহযোগিতায় তিনি বিদেশ যেতে পারলেন।
তিনি বলেন, বিদেশযাত্রায় কিছু প্রসিডিউর আছে। নিশ্চয়ই সেটি মেনেই তিনি গেছেন। ‘যদি সেটাই হয় তাহলে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো কেন’— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাদের ইশারায় বা শুধু তাদের কথায় আব্দুল হামিদের মতো ভিভিআইপি নির্বিঘ্নে চলে যেতে পারবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।’
‘অনেক সময় এটা হয় যে অজান্তেই ঘটে, কিন্তু যোগসাজশ থাকে। এটা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এখানে নিশ্চয়ই আব্দুল হামিদের যাওয়ার বিষয়ে তাদের (প্রত্যাহার হওয়া সদস্যদের) কেউ না কেউ সংশ্লিষ্ট। রাষ্ট্রীয় অবস্থান থেকে এটা জানার কথা। যদি না জেনে থাকে তাহলে কেন জানে না, সেটাও ঊর্ধ্বতনদের ব্যর্থতা।’
নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘আলাপ-আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে। যে কারণে হয়তো গাফিলতির অভিযোগ তুলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে পুলিশ। কিন্তু এটা ছোট কোনো বিষয় নয়, ঊর্ধ্বতনরা জানবেন না...! আর অধস্তনরা তো কারো নির্দেশনা পালন করেন। নির্দেশ তো কেউ না কেউ দিয়েছে। সেখানে শুধু অধস্তনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা…..!’
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, ‘বিদেশে চলে যাওয়া আটকাতে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকতে হয়। যদি কারো বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকে সেটা আদালতকে জানাতে হয়। আদালত তখন নিষেধাজ্ঞা দেয়। এক্ষেত্রে সেটা ছিল কি না, দেখতে হবে। যদি থাকে তাহলে তো সেটা বিবেচ্য বিষয়।’
‘নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় কারণে লিখিত বা অলিখিত নির্দেশনা থাকে, কার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। যারা বিমানবন্দরে দায়িত্বে ছিলেন তারা এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কি না, সেটাও দেখতে হবে। এখনে উচ্চতর কর্মকর্তাদের অবগত থাকার কথা। স্পেশাল ব্রাঞ্চ ইমিগ্রেশনের দায়িত্বে থাকে। তাদের নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা থাকবে। তাদেরও উচ্চতর কর্তৃপক্ষ আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আছে। তাদেরও ব্যাখ্যা থাকতে হবে। তবে, কিশোরগঞ্জ জেলার এসপিকে প্রত্যাহারের বিষয়টি হয়তো দ্রুত তদন্ত শেষ করতে না পারার কারণে হতে পারে।’
‘কিন্তু ধরুন কোর্টের নির্দেশনা ছিল না, সে কারণে আব্দুল হামিদকে আটকে দেয়নি পুলিশ। সমালোচনার মুখে পুলিশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। সেটাই যদি হয়ে থাকে তাহলে এটা রোগ না বুঝে ডাক্তারের চিকিৎসা দেওয়ার মতো ঘটনা’- যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, ‘ডামি রাষ্ট্রপতিকে (আব্দুল হামিদ) দেশ ছেড়ে পালাতে সহযোগিতা করায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করতে আমরা স্মারকলিপি দিয়েছি, সংবাদ সম্মেলন করেছি।’
‘অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কীভাবে তিনি (আব্দুল হামিদ) পালালেন’— এমন প্রশ্নে তুলে তিনি আরো বলেন, ‘পুলিশের যে চারজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, আমরা মনে করি এটা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার মতো বিষয়। অনতিবিলম্বে তাদের সম্মানের সঙ্গে স্বপদে বহাল করতে হবে। রাঘববোয়ালদের যোগসাজশ ছাড়া এটা সম্ভব নয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেগলিজেন্স (অবহেলা) ছিল। তাকে সরাতে হবে। এটা না করে তদন্ত কমিটি করা..., সন্দেহ কিন্তু থেকে যায়। তাহলে ধরে নিতে হবে যে, সরকারের গ্রিন সিগন্যাল ছিল। প্রধান উপদেষ্টাকেও এ ঘটনায় দায় নিতে হবে। আমরা তো শুনছি-জানছি, সরকার জানত। সুতরাং নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত করতে হবে।’
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে পুলিশের গঠিত কমিটির এক সদস্য (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘আমরা গতকাল (রোববার) অফিসিয়ালি তদন্ত কমিটি গঠনের কাগজ পেয়েছি। আজ থেকে তদন্তকাজ শুরু করেছি। বৈঠকও হয়েছে। স্পেশাল ব্রাঞ্চের বক্তব্যগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখানে ঊর্ধ্বতনদের দায় তো ছিলই। সেটা খোঁজা হচ্ছে। অধস্তনদের বিষয়টিও আমরা আমলে নিয়েছি।’
