ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

বাংলাদেশে যেভাবে এলো 'স্যার' ও 'ম্যাডাম' বলার প্রচলন

আপডেট : ১৫ জুলাই ২০২৫, ১১:২৭ এএম

বাংলার মধ্যযুগ বা মুঘল আমলের সংস্কৃতিতে রাজা বাদশাহদের জাঁহাপনা, হুজুর এমন নামে সম্বোধন করা হতো। ব্রিটিশ আমলে যখন ইংরেজি ভাষা চালু হলো, তখন অন্যান্য সম্বোধনগুলো হারিয়ে হয়ে গেল 'স্যার'। সেই জিনিসটাই এখন হয়েছে 'অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার', 'মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়', 'ভিসি মহোদয়' ইত্যাদি।

বাংলায় আগে কর্মকর্তাদের 'সাহেব' বলে সম্বোধন করার প্রচলন ছিল। সাহেব শব্দটি আরবি সাহাবী শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ সঙ্গী, সাথী, সহচর কিংবা বন্ধু।

ব্রিটিশ ও শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় নারীদের সম্বোধন করা হতো 'মেমসাহেব' বলে। বাঙালি বিবাহিত নারীদের বলা হতো 'বেগম সাহেব' । পরে সেই জায়গা স্যার বা ম্যাডাম দখল করে নেয়।

মূলত ইরানিরা ভারতবর্ষে আসার পর 'সাহিব' শব্দটির প্রচলন ঘটে। পরে তা সাহেব বা সায়েব-এ রূপ নেয়। তখন পদবির সাথে সাহেব যোগ করে ডাকা হতো যেমন–– কাজি সাহেব, সচিব সাহেব, চৌধুরী সাহেব।

তবে ইংরেজরা এদেশে আসার পর সেই সাহেব বা সায়েব সঙ্গী হিসেবে নয়, বরং 'কর্তা' হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে 'স্যার' এর বিকল্প শব্দ হিসেবে 'সাহেব' কখনো সেভাবে গৃহীত হয়নি।

বাংলাদেশের শিক্ষা ও প্রশাসনে এর ছাপ
'স্যার' ও 'ম্যাডাম' সম্বোধনের প্রচলন বাংলাদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারা থেকে নয়, বরং তা এসেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে।

বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিতে আগে শিক্ষককে বলা হতো 'মাস্টারমশাই', 'পণ্ডিতমশাই', কিন্তু সেগুলোর ব্যবহার এখন প্রায় বিলুপ্ত।

'স্যার' এবং 'ম্যাডাম' সম্বোধনের এই রেওয়াজ মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হিসেবেই বাংলাদেশে প্রোথিত হয়েছে। সেখানে অবশ্য এখন এটি প্রভুত্ব বুঝানোর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় সম্মানার্থে।

ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষককে পুরুষ হলে 'স্যার' এবং নারী হলে 'মিস' বা 'ম্যাডাম' বলা হতো। এই চর্চাই বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনেও প্রচলিত হয়েছে।

বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী বা সহকর্মী কর্তৃক কোনো নারী শিক্ষক, সেইসাথে মন্ত্রী বা বড় আমলার স্ত্রীদের সম্মানার্থ সম্বোধনের ক্ষেত্রে 'ম্যাডাম' বা 'মেম' এই দুই শব্দের প্রচলন রয়েছে।

কিন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে 'মেম' শব্দ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার যেটি দিয়ে শ্বেতাঙ্গ নারী, অভিজাত ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় নারীদের বোঝানো হত।

লেখক নিখিল সুরের সায়েবমেম সমাচার বই অনুযায়ী, পলাশী যুদ্ধের আগে অর্থাৎ ১৭৫৬ সালের দিকে সারা বাংলায় 'মেম' এর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা কয়েকজন। পরে ভারতে ব্রিটিশ রানির শাসনামলে বহু মেম সাহেবের আগমন ঘটে।

এই মেমদের অধিকাংশের জীবন ছিল ভোগ-বিলাস, আভিজাত্য, অহংকার এবং এদেশীয় গৃহভৃত্যদের প্রতি অবিচার ও শ্রেণিবিদ্বেষে পূর্ণ।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের বিদায় হলেও, বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই সংস্কৃতি বহাল থাকে। স্বাধীনতার পরেও শিক্ষা ও প্রশাসনে 'স্যার/ম্যাডাম' সম্বোধন অপরিবর্তিত থেকে যায়।

বিশেষ করে প্রশাসনিক ও শিক্ষাগত রীতিনীতিতে উপনিবেশিক চর্চা টিকে গেছে। "স্যার/ম্যাডাম" সেই মানসিক উপনিবেশের প্রতিচ্ছবি।

স্কুল-কলেজগুলোতে এখনো শিক্ষকদের 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' বলা হয় নিয়মতান্ত্রিকভাবে। শিক্ষককে 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' বলা শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক বলা যায়।

বাংলাদেশের নিম্ন আদালতের বিচারকবৃন্দকে আইনজীবী বা বিচারপ্রার্থীরা 'স্যার' বা 'ইওর অনার' বলে থাকেন। অন্যদিকে উচ্চ আদালতের বিচারকবৃন্দকে 'মাই লর্ড', 'মি লর্ড' সম্বোধনে ডাকা হয়।

অথচ বাংলাদেশের আইনজীবীদের পেশাগত শৃঙ্খলা ও আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী আইন বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার অ্যান্ড রুলস, ১৯৭২ এবং ক্যানন্স অব প্রফেশনাল কন্ডাক্ট অ্যান্ড এটিকেটের কোথাও এমন কোনো বিধান নেই।

অধস্তন আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত আইন দ্য সিভিল রুলস অ্যান্ড অর্ডার্স (সিআরও) এর ৮২৫ ও ৮২৬ বিধিতে আইনজীবীদের নির্দিষ্ট পোশাক-পরিচ্ছেদের জন্য আইনগত বাধ্যকরী নির্দেশনা থাকলেও সম্বোধনের ক্ষেত্রে স্যার, মাই লর্ড, মি লর্ড বলার কোনো আইনগত বিধান নেই।

২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত আইন দ্য সুপ্রিম কোর্ট (হাই কোর্ট ডিভিশন) রুলস, ১৯৭৩ সংশোধন করে এই আইনে বিচারককে সম্বোধনের ক্ষেত্রে সম্মান প্রদর্শনমূলক সম্বোধনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু স্যার বলতে নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।

মুনতাসীর মামুনের 'ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন' বইয়ে উল্লেখ করা হয়, সময়ের সঙ্গে স্যার, ম্যাডাম সম্বোধন হয়ে উঠেছে ক্ষমতার প্রতীক, শ্রদ্ধা প্রকাশের রীতি এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আদবকায়দার অংশ।

স্যার ম্যাডাম ডাক নিয়ে বাংলাদেশে প্রচলিত নিয়ম
জনপ্রশাসন বা সরকারি কর্মকর্তাদের 'স্যার বা ম্যাডাম' নামে সম্বোধনের রেওয়াজ বা রীতি যুগযুগ ধরে চলে এলেও ১৯৯০ সালে তা রদ করা হয়। ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর সেই সময়ের সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে।

ওই মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মো. ফজলুল হকের স্বাক্ষরে জারি করা প্রজ্ঞাপনে সরকারি অফিস বা প্রতিষ্ঠানে সম্বোধনের জন্য 'স্যার'-এর পরিবর্তে 'জনাব' ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়।

প্রজ্ঞাপনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, 'সরকারি অফিসার বা কর্মকর্তাদের নামে প্রেরিত পত্রাদির শুরুতে পুরুষের ক্ষেত্রে 'মহোদয়' ও মহিলাদের ক্ষেত্রে 'মহোদয়া' লেখা যাইতে পারে।"

সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সচিবালয়ে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত এক সংলাপে বলেছিলেন, ''সরকারি সেবা নিতে আসা জনসাধারণকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' বলে সম্বোধনের কোনো নীতি নেই।''

বাংলাদেশে 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' সম্বোধন সংক্রান্ত কোনো সরকারি আইন, বিধিমালা বা নীতিমালা নেই। এটি মূলত একটি প্রথাগত বা সামাজিক রীতি, যা শিক্ষা, প্রশাসন এবং কর্পোরেট জগতে বহুদিন ধরে চলে আসছে।

বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' সম্বোধন বাধ্যতামূলক করে এমন কোনো নির্দেশনা বা পরিপত্র জারি হয়নি।

২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি বা তার পরবর্তী হালনাগাদ সংস্করণে শিক্ষকের প্রতি সম্মান বজায় রাখা নিয়ে কিছু উল্লেখ থাকলেও 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' ডাকার বাধ্যবাধকতা নেই।

শিক্ষককে 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' বলা একটি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত রীতি। এটি সাধারণত শৃঙ্খলার অংশ হিসেবে শেখানো হয়, যদিও নিয়মে বাধ্যতামূলক নয়।

শিক্ষক ও কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সংক্রান্ত কিছু সাধারণ দিকনির্দেশনা থাকলেও সুনির্দিষ্টভাবে 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' বলা বাধ্যতামূলক- এমন কোনো লিখিত নিয়ম নেই।

তবে সরকারি অফিসে 'স্যার' বা 'ম্যাডাম' ডাক এখন অনানুষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৩ ও ১৩৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের 'পাবলিক সার্ভেন্ট' বা 'সরকারি কর্মচারী' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

কোথাও 'কর্মকর্তা' বলা হয়নি। তাদের মূল পরিচয় জনগণের সেবক হিসেবে।

অথচ সরকারি কর্মচারীদের স্যার বা ম্যাডাম বলে না ডাকায়, তার পরিবর্তে ভাই, আপা বা দাদা সম্বোধন করায় বিভিন্ন সময়ে সেবাগ্রহীতারা নানা বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়ার নানা খবর প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে 'স্যার' সম্বোধন মূলত প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ভেতর থেকে 'প্রটোকল' হিসেবে চালু ছিল।

যার কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, প্রটোকল অফিসার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এমনকি সচিবরা শেখ হাসিনাকে 'স্যার' বলেই সম্বোধন করতেন।

বিষয়টি যদিও সরকারি গেজেট বা প্রাতিষ্ঠানিক বিধিমালায় লিপিবদ্ধ ছিল না।

বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদদের মতে, বাংলাদেশে 'স্যার/ম্যাডাম' সম্বোধনের পেছনে কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকলেও এটি একটি ঔপনিবেশিক আমলের রীতিনীতির সামাজিক সংস্কৃতি যা আজও টিকে আছে।

সর্বশেষ ২০২৫ সালের ১১ই জুলাই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য সিনিয়র নারী কর্মীদের 'স্যার' বলার নিয়ম বাতিল করে। এই সম্বোধনকে 'অপ্রাসঙ্গিক' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

AHA
আরও পড়ুন