প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের ২৭ তারিখ এলে পৃথিবীজুড়ে অন্যরকম উৎসাহের সৃষ্টি হয়। এ দিনটি হলো বিশ্ব পর্যটন দিবস। দিনটি কেবল হোটেল বা রিসোর্টের ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা ছুটি কাটানোর কথা মনে করায় না। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভ্রমণের গভীরতর অর্থের দিকে। তাহলে ভ্রমণ বলতে আমরা কী বুঝি? শুধুই কি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছানো? না-কি এই শব্দের অর্থ তার চেয়ে অনেক গভীর এবং ব্যাপক?
একটি ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে বলি। আমরা যখন বাড়িতে টেলিভিশন বা মোবাইল ফোনে দূর-দূরান্তের কোনো সুন্দর জায়গার ছবি দেখি, তখন শুধু আমাদের চোখই আনন্দ পায়। কিন্তু যখন আমরা সত্যিকার অর্থে সেই জায়গায় উপস্থিত হই, তখন শুধু চোখ নয়, আমাদের সারা শরীর ও মন এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। চোখে দেখা পাহাড়ের টাটকা সবুজ রঙ, কানে শোনা নদীর অবিরাম কলতান, আর নাকে ভেসে আসা বনের সতেজ গন্ধ— এসব একসঙ্গে মিলিয়ে যে সমন্বিত অনুভূতি তৈরি হয়, তা বাড়িতে বসে কোনোভাবে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। বিশ্ব পর্যটন দিবস এই পুরো অভিজ্ঞতার মূল্যকে আমাদের সামনে তুলে ধরে।
আমরা বইতে পড়ি ইতিহাস, ভূগোল, সমাজবিজ্ঞান। কিন্তু সত্যিকারের পাঠ তো শুরু হয়, যখন আমরা নিজের চোখে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা কোনো স্মৃতিস্তম্ভ দেখি। যখন হাতে ছুঁয়ে দেখি কয়েকশ’ বছরের পুরোনো মন্দিরের পাথর। যখন কোনো আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে বসে তাদের জীবনযাপন সরেজমিনে গিয়ে অবলোকন করি। সেটা আর দশটা বই পড়ার অভিজ্ঞতার মতো নয়। তখন শেখাটা শুধু মস্তিষ্কে জমা হয় না, তা হৃদয়ে গেঁথে যায়।
একজন শহুরে মানুষের জন্য গ্রাম-বাংলার জীবনযাত্রা দেখা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কীভাবে কৃষক ভোর না হতে ক্ষেতে চলে যায়, কীভাবে মাছ ধরা হয়, কীভাবে হাট বসে– এগুলো দেখলে শহুরে ব্যস্ত জীবনের বাইরে আরেকটি পৃথিবীর অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়। এই উপলব্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে, সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করে।
আমরা যখন কোনো নতুন স্থানে ভ্রমণ করি, তখন শুধু আমরা নিজেরা লাভবান হই না, সেখানকার স্থানীয় মানুষও এর সুফল ভোগ করে। আমাদের ভ্রমণব্যয় থেকে সেখানকার ছোট ছোট হোটেল, রিকশাচালক, পথনির্দেশক এবং দোকানদার— সবার জীবন-জীবিকায় একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। এটি একটি চমৎকার চক্র। আমরা তাদের কাছ থেকে সৌন্দর্য ও অভিজ্ঞতা গ্রহণ করি, আর তারা আমাদের কাছ থেকে পায় তাদের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখার সুযোগ। বিশ্ব পর্যটন দিবস এই পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্ককে স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে আছে সুন্দরবন, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন বা পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো অসাধারণ সব পর্যটন স্থান, সেখানে স্থানীয় মানুষের আয়ের একটি বড় উৎস হতে পারে পর্যটন শিল্প।
আমাদের দৈনন্দিন জীবন বর্তমানে অনেক চাপে ভরা। অফিসের কাজ, সংসারের দায়িত্ব, রাস্তাঘাটের যানজট— এসবের ভিড়ে যখন মন খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন একটি ছোট্ট ভ্রমণই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ। পরিচিত পরিবেশ থেকে কয়েকদিনের জন্য দূরে যাওয়া মানে মনকে একটু টাটকা হাওয়া লাগানো। নতুন জায়গা, নতুন মানুষের সংস্পর্শ, নতুন ধরনের খাবার— এই ‘নতুনত্ব’ মনকে প্রাণবন্ত করে তোলে। কাজে ফিরে গেলে আমরা তখন নতুন শক্তি ও উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি। তাই ভ্রমণকে শুধু ফুর্তি হিসেবে না দেখে, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য একটি কার্যকলাপ হিসেবেও দেখা উচিত।
অনেকের ধারণা, ভ্রমণ মানে হচ্ছে দূরের কোনো স্থানে গিয়ে অঢেল টাকা খরচ করে বিলাসিতা করা। আসলে ব্যাপারটি মোটেও তা নয়। ভ্রমণের আসল আনন্দ লুকিয়ে আছে অভিজ্ঞতা অর্জনে। বাড়ির খুব কাছের কোনো ছোট বন, নদীর তীর, ঐতিহাসিক স্থান কিংবা শুধু আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি— যেকোনো জায়গাই হতে পারে ভ্রমণের গন্তব্য। গুরুত্বপূর্ণ হলো— কৌতূহলী মন নিয়ে বের হওয়া। চারপাশের জগৎকে গভীরভাবে দেখা ও বোঝার চেষ্টা করা। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলা। তাদের রান্না করা খাবার খাওয়া। এই ছোট ছোট কাজের মধ্যে নিহিত আছে ভ্রমণের আসল তৃপ্তি।
বিশ্ব পর্যটন দিবসে আমাদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কথা ভাবতে হবে। আমরা যখন কোনো সুন্দর জায়গায় যাই, তখন আমাদের দায়িত্বশীলও হতে হবে। প্লাস্টিকের বোতল বা পলিথিন যেখানে-সেখানে ফেলা যাবে না। প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন স্থানে নিজের নাম খোদাই করার মতো বদঅভ্যাস পরিহার করতে হবে। স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সম্মান করতে হবে। আমরা যেন কেবল পায়ের ছাপ রেখে আসি, ময়লা-আবর্জনা ফেলে না আসি। আমাদের ভ্রমণ যেন প্রকৃতি ও স্থানীয় জনগণের জন্য বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়।
বিশ্ব পর্যটন দিবস কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি একটি স্মরণিকা। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভ্রমণ জীবনের একটি অপরিহার্য অধ্যায়। এটি আমাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও সুখ— এই ৩টি একসঙ্গে বাড়িয়ে তোলে। তাই আসুন, শুধু সেপ্টেম্বর মাসের ২৭ তারিখে নয়, বছরের যেকোনো সময়, সামান্য সুযোগ পেলে নিজের ও পরিবারের এবং দেশের অর্থনীতির জন্য ভ্রমণে বের হয়ে পড়ি। নতুন কিছু শিখি, নতুন কিছু দেখি। কারণ, এই পৃথিবী একটি অপূর্ব সৃষ্টি, আর যে ব্যক্তি শুধু একটি জায়গায় বসে থাকে, সে যেন জীবনের এক পৃষ্ঠা পড়েই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। ভ্রমণে বের হোন, জীবনটাকে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করুন।
লেখক : সাংবাদিক
