ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

রাজনীতির মাঠে নতুন খেলোয়াড় ও একটি ফুলের গল্প॥ কাউছার খোকন

আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১২ এএম

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতীক কখনোই শুধু একটি ছবি বা চিহ্ন নয়। প্রতীক হয়ে ওঠে মানুষের আশার বাহক, সংগ্রামের প্রেরণা এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রতীক। ‘নৌকা’ মানে আওয়ামী লীগ, ‘ধানের শীষ’ মানে বিএনপি– এই চিহ্নগুলো মানুষের মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে। এমনই একটি প্রতীক ‘শাপলা’। 

সাদা শাপলা ফুল শান্তি ও নির্মলতার প্রতীক। এটি যেন বলে, রাজনীতি হওয়া উচিত শান্তিপূর্ণ, নির্মল ও মানুষের সেবার জন্য। শাপলা তাই এখন আর শুধু একটি ফুল বা প্রতীক নয়, এটি বাংলাদেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার জীবন্ত প্রকাশ। শাপলা ফুল তার সৌন্দর্য ও সরলতা দিয়ে যেমন আমাদের প্রকৃতিকে সমৃদ্ধ করে, তেমনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এটি একটি বিশেষ দল, তাদের আদর্শ ও ইতিহাসের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই শাপলা ফুলকে নিজেদের প্রতীক হিসেবে পেতে চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তাদের এই দাবি রাজনৈতিক মহলে অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এই দাবি কতটা যৌক্তিক? এটি কি শুধুই অতীতের প্রতি একটি আবেগ, নাকি এর গভীরে আছে রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও আইনগত ভিত্তি? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।

আসুন আমরা একটু পেছনে ফিরে তাকাই, জাতীয় নাগরিক পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য যখন নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছিল, তখন প্রতীক হিসেবে শাপলা, কলম ও মোবাইল চেয়েছিল। কয়েকদিন পরে আবার আরেকটি চিঠি দিয়ে সংশোধিত আবেদন করে এনসিপি। ওই চিঠিতে শাপলা, লাল শাপলা অথবা সাদা শাপলা থেকে যেকোনো একটি প্রতীক চায় দলটি। গত কয়েক মাস ধরেই এনসিপি নেতাকর্মীরা শাপলা প্রতীকের দাবিতে বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে একাধিকবার দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা পেতে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকও করেছে এনসিপি।

তবে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে নির্বাচন কমিশন গত ৩০ সেপ্টেম্বর এনসিপিকে যে চিঠি পাঠায়, তাতে বলা হয়, ৭ অক্টোবরের মধ্যে ইসির তালিকাভুক্ত ৫০টি প্রতীক থেকে পছন্দের যেকোনো একটি প্রতীক নেওয়ার জন্য। একই সঙ্গে ওই চিঠিতে জানানো হয় দলটির প্রথম পছন্দ ‘শাপলা’ বর্তমানে নির্বাচন পরিচালনার বিধিমালার তালিকায় নেই, তাই এটি বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব ও আইন সম্পাদক জহিরুল ইসলাম মুসা জানিয়েছেন, তারা নির্বাচন কমিশনকে ইমেইলের মাধ্যমে চিঠির জবাব দিয়েছেন। এনসিপি ইসিকে জানিয়েছে, শাপলার বাইরে অন্য প্রতীক তারা গ্রহণ করবে না। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠির সঙ্গে শাপলা প্রতীকের সাত ধরনের নমুনাও যুক্ত করে দেওয়া হয়। মুসা বলেন, ‘যেহেতু শাপলা প্রতীক পেতে আমাদের কোনো আইনগত জটিলতা নেই, সে কারণে আমরা ইসিকে আমাদের আগের অবস্থানই পুনর্ব্যক্ত করেছি। এনসিপি শাপলার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেবে না।’

এনসিপির কয়েকজন নেতা দাবি করেছেন, দলটিকে শাপলা প্রতীক দেওয়ার ব্যাপারে মূল আপত্তি একটি গোয়েন্দা সংস্থার, যে কারণে নির্বাচন কমিশন চাইলেও স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, ‘শাপলা প্রতীক পেতে এনসিপির চিঠির সঠিক ব্যাখ্যাও ইসি দিতে পারেনি কমিশন। ইসি কোনো অদৃশ্য শক্তির চাপে এনসিপিকে শাপলা প্রতীক থেকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছে।’ একই সঙ্গে দলটির নেতারা এটিও বলছেন, ‘যদি শেষ পর্যন্ত এনসিপিকে শাপলা প্রতীক না দেওয়া হয়, তাহলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তাতে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত দলগত অবস্থান রয়েছে তাদের।’ এনসিপির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তারা কোনো আইনি ব্যাখ্যা ছাড়া একটা সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর চাপিয়ে দেবে, এটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এটা কোনোভাবেই হবে না।’

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বর রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী, নাগরিক ঐক্যকে নিবন্ধন দেওয়ার পাশাপাশি দলীয় প্রতীক দেওয়া হয় ‘কেটলি’। নিবন্ধন পাওয়ার ৯ মাসের মাথায় চলতি বছরের ১৭ জুন নির্বাচন কমিশনের কাছে দলীয় প্রতীক পরিবর্তনের জন্য আবেদন জানায় নাগরিক ঐক্য। তারা দলীয় প্রতীক ‘কেটলি’র পরিবর্তে শাপলা বা দোয়েল পাখি বরাদ্দের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করে।

মূলত, নিবন্ধন পাওয়ার আগেই এনসিপি তাদের পছন্দের প্রতীক হিসেবে শাপলাকে বাছাই করে। গত জুলাইয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারা যে পথযাত্রা করেছে, সেখানেও তারা শাপলা প্রতীক নিয়ে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিল। নিবন্ধন ও প্রতীক পাওয়ার পর আবার নতুন করে মাহমুদুর রহমান মান্নার শাপলা প্রতীক চেয়ে চিঠির বিষয়টিকেই সামনে এনেছে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের ব্যাখ্যা, এনসিপির আগেই শাপলা প্রতীক চেয়েছিল মান্নার নাগরিক ঐক্য। যে কারণে নতুন করে বিতর্ক এড়াতে শাপলাকে তারা প্রতীক তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে।

এর আগে এনসিপি নেতাকর্মীরা বিষয়টি নিয়ে মান্নার সঙ্গে সাক্ষাৎও করেন। পরে এনসিপির নিবন্ধন চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রতীক প্রশ্নে জটিলতা তৈরি হওয়ার পর এক ফেসবুক পোস্টে মাহমুদুর রহমান মান্না লেখেন, ‘শাপলা প্রতীক যদি তাদের (এনসিপি) দিয়ে দেয়, কোনো মামলা করবো না। কিন্তু প্রতিবাদ তো করবো।’ তিনি বলেন, ‘এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দিলে ইসির প্রতি আমাদের আপত্তি থাকবে। তবে ছাত্রদের প্রতি আমাদের রেসপেক্ট আছে। সেখান থেকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো মামলা করবো না বা আইনি লড়াইয়ে যাবো না।’

এবার আসা যাক মূল কথায়। বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতীক। এটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালে সদ্যঃস্বাধীন দেশের জাতীয় প্রতীক ও বিভিন্ন মনোগ্রাম তৈরি করতে বাংলাদেশ সরকার শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসানের ওপর দায়িত্ব দেয়। বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকের কেন্দ্রে রয়েছে পানিতে ভাসমান একটি শাপলা ফুল, যা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। শাপলা ফুলটিকে বেষ্টন করে আছে ধানের দুটি শীষ। চূড়ায় পাটগাছের পরস্পরযুক্ত তিনটি পাতা এবং পাতার উভয় পাশে দুটি করে মোট চারটি তারকা। পানি, ধান ও পাট প্রতীকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে বাংলাদেশের নিসর্গ ও অর্থনীতি।

‘শাপলা’ বাংলাদেশে জাতীয় প্রতীক হিসেবে সংবিধান ও আইনানুযায়ী স্বীকৃত। রাজনীতিতে কোনো দল প্রতীকে শাপলা প্রতীক নেওয়ার বিষয়ে আইনগত ও নীতি-ভিত্তিক বাধা রয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানিয়েছে, শাপলা কোনো রাজনৈতিক প্রতীকে দেওয়া যাবে না। তবে এনসিপি দল যুক্তি দেয়, অন্য জাতীয় উপাদান ইতোমধ্যে রাজনৈতিক প্রতীকে রয়েছে, তাহলে শাপলা কেন নয়? এই প্রতীকের রূপ ও ব্যবহার শুধুই চিহ্ন নয়, রাজনৈতিক পরিচয়, সাংগঠনিক পরিচয় ও জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। এনসিপি দাবি করেছে, ‘যদি ধানের মাথা জাতীয় প্রতীক থেকে নেওয়া যায়, তাহলে শাপলাও নেওয়া যেতে পারে।’ এদিকে, ইসি বলেছে, ‘না, শাপলা জাতীয় প্রতীক হিসেবে এত সাধারণ যে তা রাজনৈতিক প্রতীকে দেওয়া উপযুক্ত নয়।’

সোমবার (২০ অক্টোবর) নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘আমরা এনসিপিকে ৫০টি প্রতীক থেকে বাছাই করে জানাতে বলেছিলাম। ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। শেষদিন দলটির একটি প্রতিনিধিদল এসে ফের শাপলা চেয়ে আবেদন জানিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘দলটির পুনঃআবেদনের প্রেক্ষিতে বিষয়টি আবার কমিশনের কাছে তোলা হবে। কমিশন সিদ্ধান্ত দেবে কোন প্রতীক দেওয়া হবে তাদের।’ রোববার (১৯ অক্টোবর) সকালে নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এনসিপির প্রতিনিধিদল। কমিশনে এসে এনসিপি নেতারা বলেন, ‘কোনো ধরনের চাপিয়ে দেওয়া প্রতীক তারা নেবে না।’ শাপলা প্রতীকের বিষয়ে অনড় অবস্থানের কথা তুলে ধরে ইসির চিঠির জবাব দিয়েছে দলটি।

যৌক্তিকতার কয়েকটি দিক থেকে এনসিপির শাপলা প্রতীক চাওয়ার দাবিটির বিচার করা যায়। রাজনীতি শুধু আইন ও ইতিহাসের বিষয় নয়, এটি জনসমর্থনেরও খেলা। এনসিপির জন্য শাপলা চাওয়ার পেছনে একটি বড় রাজনৈতিক কৌশলও কাজ করতে পারে। শাপলা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অত্যন্ত পরিচিত ও শক্তিশালী ব্র্যান্ড। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের মালিকানা নেওয়ার মতো। ভোটার, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের ও কম শিক্ষিত ভোটাররা একটি পরিচিত প্রতীকের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। এনসিপি যদি শাপলা পায়, তাহলে তাদের নতুন করে পরিচয় দিতে হবে না। এনসিপির শাপলা প্রতীক চাওয়ার দাবিটি তাদের নিজস্ব ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে যৌক্তিক হতে পারে। এটি তাদের আত্মপরিচয় ও আদর্শিক সংগ্রামের একটি অংশ। তাদের জন্য শাপলা শুধু একটি ফুলের ছবি নয়, এটি তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের স্বীকৃতি। তবে বৃহত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতা, আইনি বাধা এবং জনমনের অবস্থানের কারণে এই দাবির বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। একটি প্রতীক তখনই শক্তি পায় যখন তা নির্দিষ্ট আদর্শ, কর্মসূচি ও জনসেবার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, একটি প্রতীক তখনই কার্যকর হয় যখন তার পেছনে শক্তিশালী সংগঠন ও জনভিত্তি থাকে। এনসিপির বর্তমান সংগঠন ও জনভিত্তি সীমিত। তাই শাপলা পেলেও তারা তা কতটা কাজে লাগাতে পারবেন, তা একটি বড় প্রশ্ন। এনসিপি একটি প্রতীকের পেছনে সময় ও শক্তি নষ্ট করছে, যা তারা কোনো দিনই পাবে না। বরং তাদের উচিত নিজস্ব একটি নতুন পরিচয় ও আদর্শ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। একটি নতুন প্রতীকের মাধ্যমেই তারা তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারতেন।

শাপলার জন্য এনসিপির এই লড়াই আমাদের একটি গভীরতর শিক্ষা দেয় যে, রাজনীতিতে প্রতীক গুরুত্বপূর্ণ হলেও, চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ, সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি এবং একটি শক্তিশালী, জবাবদিহিমূলক সংগঠনের ওপর। প্রতীকের জন্য লড়াইয়ের চেয়ে জনগণের অধিকারের জন্য লড়াইয়েই একটি দলের শক্তি ও যৌক্তিকতা বেশি প্রমাণিত হয়।

আরও পড়ুন