ঢাকা
মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

যেভাবে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া

আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১৯ এএম

তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, একাধিকবার ছিলেন বিরোধী রাজনীতির প্রধান চরিত্র। ছিলেন গণআন্দোলনের প্রতীক। হয়ে ওঠেন আপসহীন নেত্রী। তিনি বেগম খালেদা জিয়া। দেশে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রপথিক হয়ে আছেন মহীয়সী এই নারী। একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে খালেদা জিয়া কীভাবে দেশের রাজনীতির অন্যতম সেরা চরিত্র হয়ে উঠলেন আপনাদের সেই গল্প শোনাবো আজ।

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে হত্যা করা হলে খালেদা জিয়া তখন ছিলেন নিতান্তই গৃহবধূ। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে তিনি অবস্থান করছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে। রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যুর ধাক্কায় বিএনপি তখন দিশেহারা; দলের ভিতরে শুরু হয় নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েন। জিয়াউর রহমানের পর দলের হাল কে ধরবে, তা নিয়ে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে মতানৈক্য তীব্র হতে থাকে।

সে সময় ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এবং রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ব্যক্তি হিসেবে তখনকার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সাত্তারের ভাবমূর্তি খুব শক্ত ছিল না। ফলে বিএনপির একাংশ চাইছিল দলের নেতৃত্ব নতুন করে নির্ধারণে কাউন্সিল ডাকা হোক। অন্যদিকে সরকারে থাকা আরেক অংশ এর বিরোধিতা করে।

মওদুদ আহমদ তার ‘চলমান ইতিহাস’ বইয়ে লিখে গেছেন, সামরিক ও শাসকচক্রের প্রধান আশঙ্কার নাম ছিল খালেদা জিয়া। কারণ চাইলে তিনিই তখন সবচেয়ে শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারতেন। কিন্তু তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে আব্দুস সাত্তারকে প্রার্থী করা হয়। সেনাপ্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদও সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে আগ্রহী ছিলেন। বিএনপি ভেতরে মতভেদ থাকলেও শেষ পর্যন্ত এরশাদের ইচ্ছাই বাস্তবায়িত হয়।

জিয়াউর রহমানের শাসনামলে খালেদা জিয়াকে জনসমক্ষে খুব একটা দেখা যেত না। লাজুক ও সংসারকেন্দ্রিক একজন নারী হিসেবে তিনি সন্তানদের দেখাশোনা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। ফলে তাঁর রাজনীতিতে আগমন অনেককে বিস্মিত করে। সাত্তারের নেতৃত্ব নিয়ে দলের অসন্তোষ বাড়তে থাকলে বিএনপির একাংশ খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু জিয়ার হত্যাকাণ্ডের মানসিক ধকল, রাজনীতিতে অনাগ্রহ এবং পরিবারের নিরুৎসাহ—সব মিলিয়ে তিনি শুরুতে রাজনীতিতে আসতে চাননি।

সাবেক সামরিক কর্মকর্তা আকবর হোসেন, নুরুল ইসলাম শিশু ও একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর তৎপরতায় অবশেষে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৮২ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন। একই বছরের ৭ নভেম্বর জিয়ার সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য দেন।

বিএনপির তরুণ অংশ খালেদা জিয়াকে দলের প্রধান হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। অন্যদিকে সেনাপ্রধান এরশাদ চাইছিলেন বিচারপতি সাত্তারই নেতৃত্বে থাকুন। দুজনই দলীয় প্রধানের প্রার্থী হলে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। দীর্ঘ আলোচনার পর খালেদা জিয়া চেয়ারম্যান প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাত্তারকে অপসারণ করলে তিনি কার্যত রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব হারান। এরপর থেকেই বিএনপি পরিচালনায় খালেদা জিয়ার ভূমিকা দৃশ্যমানভাবে বাড়তে থাকে। ১৯৮৩ সালে তিনি সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান এবং পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে মাঠে নেমে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার পরিচিতি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে খালেদা জিয়া প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। পরের নির্বাচনে বিরোধী দলে গেলেও ২০০১ সালে ফের ক্ষমতায় আসে তার দল। আবার প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। এরপর আলোচিত ওয়ান-এলিভেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ভরাডুবি হলে একনায়কতন্ত্র কায়েম করে আওয়ামী লীগ। অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া ও বিএনবি বুঝি শেষ। এই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছেন খালেদা জিয়া। গণতন্ত্রের প্রশ্নে কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেকে আপোসহীন নেত্রী হিসেবে প্রমাণ করেছেন তিনি। মিথ্যা মামলায় তাকে জেলে যেতে হয়েছে, সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি খালেদা জিয়া।

খালেদা জিয়ার কঠিন অবস্থানের ফলেই দেশে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী বিরোধী মনোভাব ক্রমেই জোরালো হয়। বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে তাকে যারা শেষ করে দিতে চেয়েছিল গণআন্দোলনের মুখে তারাই আজ বিতাড়িত। খালেদা জিয়া ছিলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রপথিক। বিশ্ব নারী নেতৃত্বের উজ্জ্বলতম নাম।

AHA
আরও পড়ুন