হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর ১২ জন সন্তান ছিলেন। ইউসুফ (আ.) ও বিন ইয়ামিন তাদের মধ্যে অন্য মায়ের। তারা দুজন সবার ছোট ছিলেন। ইয়াকুব (আ.) ছোট দুই সন্তানকে কিছুটা বেশি স্নেহ করতেন। এ বিষয়টি বড় ১০ ভাই ঈর্ষার চোখে দেখতেন। তারা ইউসুফকে বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করতে দূরে জঙ্গলে কূপে ফেলে দেয়।
বণিক কাফেলা সেখান থেকে ইউসুফকে উদ্ধার করে মিসরের বাদশার কাছে বিক্রি করে। ঘটনাক্রমে রাজপ্রাসাদ থেকে জেলে যেতে হয় ইউসুফকে। সেখান থেকে পরবর্তীতে তিনি আবার মিসরের রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদে স্থান পান।
এ সময় মিসরে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইউসুফ (আ.)-এর বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলে মিসরের তৎকালীন রাজধানী অঞ্চল দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পায়। এবং রাজদরবার থেকে জনগণের জন্য স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে খাদ্যশস্য প্রদানের নিয়ম করা হলো।
এই সংবাদ মিসরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লো। ইউসুফ (আ.)-এর বাবা ইয়াকুব (আ.) এ কথা জানতে পেয়ে খাদ্যশস্যের জন্য নিজের ১০ সন্তানকে মিসরে পাঠালেন। মিসরে ভাইদের দেখে চিনতে পারলেন ইউসুফ (আ.)। কিন্তু তারা ছোট ভাই ইউসুফকে চিনতে পারলো না।
ইউসুফ (আ.) ভাইদেরকে রাজকীয় মেহমানের মর্যাদায় রাখলেন, তাদের আরেক ভাই বিন ইয়ামিন সম্পর্কেও খোঁজ খবর নিলেন এবং যথারীতি খাদ্যশস্য প্রদান করার আদেশ দিলেন। বন্টনের ব্যাপারে ইউসুফ (আ.)-এর রীতি ছিল, একবারে কোনো এক ব্যক্তিকে এক উটের বোঝার চাইতে বেশী খাদ্যশস্য দিতেন না। হিসাব অনুযায়ী যখন তা শেষ হয়ে যেত, তখন আবার দিতেন।
খাদ্যশস্য দেওয়ার পর তিনি ভাইদেরকে বললেন, তোমরা যখন আবার আসবে, তখন তোমাদের সেই ভাইকেও সঙ্গে নিয়ে এসো এবং বললেন, তোমরা যদি সেই ভাইকে সাথে না আন, তবে আমি তোমাদের কাউকেই খাদ্যশস্য দেবো না।
ইউসুফ (আ.) ভাইয়েরা মিসর থেকে খাদ্যশস্য নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার পর বাবাকে বললেন, আবার যখন খাদ্যশস্য নিতে যাবো তখন বিন ইয়ামিনকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছেন মিসরের বাদশা। তিনি বলেছেন যে, ছোটভাইকে সাথে আনলে খাদ্যশস্য পাবে, অন্যথায় নয়।
ভাইদের সঙ্গে পাঠিয়েছি সন্তান ইউসুফকে হারিয়েছিলেন ইয়াকুব (আ.)। তাই প্রথমে তিনি বিন ইয়ামিনকে তাদের সঙ্গে পাঠাতে রাজি হলেন না, কিন্তু পরে আল্লাহর নামে শপথ পরিয়ে অঙ্গীকার নিলেন এবং বিন ইয়ামিনকে ভাইদের সঙ্গে মিসরে পাঠালেন। তবে তারা ১১ ভাই যেহেতু একই পিতার উরস থেকে জন্ম নিয়েছিলেন এবং সবাই যুবক ও সুঠামদেহী ছিলেন, তাদের দেখে যেন কারো বদ নজর না লাগে তাই তিনি তাদের উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন—
তোমরা ১১ ভাই শহরের একই প্রবেশ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করো না, বরং নগর প্রাচীরের কাছে পৌছে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেয়ো এবং বিভিন্ন দরজা দিয়ে শহরে প্রবেশ করো।
পবিত্র কোরআনে এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে এভাবে—
وَ قَالَ یٰبَنِیَّ لَا تَدۡخُلُوۡا مِنۡۢ بَابٍ وَّاحِدٍ وَّ ادۡخُلُوۡا مِنۡ اَبۡوَابٍ مُّتَفَرِّقَۃٍ ؕ وَ مَاۤ اُغۡنِیۡ عَنۡكُمۡ مِّنَ اللّٰهِ مِنۡ شَیۡءٍ ؕ اِنِ الۡحُكۡمُ اِلَّا لِلّٰهِ ؕ عَلَیۡهِ تَوَكَّلۡتُ ۚ وَ عَلَیۡهِ فَلۡیَتَوَكَّلِ الۡمُتَوَكِّلُوۡنَ
আর তিনি বললেন, হে আমার পুত্ৰগণ! তোমরা এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করে না, ভিন্ন ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে আল্লাহর সিদ্ধান্তের বিপরীতে আমি তোমাদের জন্য কিছু করতে পারি না। হুকুমের মালিক তো আল্লাহই। আমি তারই উপর নির্ভর করি। আর আল্লাহরই উপর যেন নির্ভরকারীরা নির্ভর করে। (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৬৭)
মুফাসসিরদের মতে, ইয়াকুব (আ.) সন্তানদের এমন উপদেশ দানের কারণ এই আশঙ্কা ছিল যে, স্বাস্থ্যবান, সুঠামদেহী, সুদৰ্শন এবং রূপ ও ঔজ্জ্বল্যের অধিকারী এসব যুবক সম্পর্কে যখন লোকেরা জানবে যে, এরা একই পিতার সন্তান এবং ভাই, তখন কারো বদ নজর গেলে তাদের ক্ষতি হতে পারে। অথবা সঙ্গবদ্ধভাবে প্রবেশ করার কারণে হয়ত কেউ হিংসাপরায়ণ হয়ে তাদের ক্ষতি সাধন করতে পারে। এই সতর্কতা বশত তিনি এই উপদেশ দিয়েছিলেন।
উপরের ঘটনা থেকে লক্ষণীয় বিষয় হলো, অতি প্রদর্শনী ও মানুষকে দেখানোর প্রবণতা পরিহার করা উচিত। এতে নজর লাগতে পারে।
যথাসম্ভব বদ নজর থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। কারণ, বদ নজরের বিষয়টি সত্য। একাধিক হাদিসে রাসুল (সা.) এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা বদ নজরের প্রভাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। কেননা নজরের প্রভাব সত্য।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৫০৮)
জীবনে পরিবর্তন দরকার, ৫টি হাদিসের আমল করুন