ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

আশুরার রোজা রাখার বিধান

আপডেট : ২৮ জুন ২০২৫, ১১:৩৮ পিএম

আরবি সনের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখকে পবিত্র আশুরা বলা হয়। দিনটি অত্যন্ত সম্মানিত ও বরকতময় দিন। এর সঙ্গে মিশে আছে ইসলামের ইতিহাসের তাৎপর্যময় বহু ঘটনা। আশুরা তথা দশম মহররমের  এই দিনের ফজিলত সম্পর্কে অনেক বানোয়াট, মিথ্যা কথা ও জঈফ (সনদের দিক থেকে দুর্বল) রেওয়ায়েত জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত। অতএব, সহিহ হাদিসের আলোকে আশুরার ফজিলতগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো-

আশুরার রোজার ফজিলত
পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহর কাফফারা। আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলার কাছে আমি আশা পোষণ করি যে তিনি আশুরার রোজার মাধ্যমে পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ১১৬২; জামে আত-তিরমিজি, হাদিস নম্বর ৭৫২)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে আশুরার দিনে রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে জবাবে তিনি বলেন, তা বিগত এক বছরের গুনাহ মোচন করে দেয়।(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৮০৪)

রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা আশুরার রোজা
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কে আশুরার দিনে রোজা পালন করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার পর তিনি বললেন, এ দিন ছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো দিনকে অন্য দিনের তুলনায় উত্তম মনে করে সেদিনে রোজা পালন করেছেন বলে আমার জানা নেই। অনুরূপভাবে রমজান ছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো মাসকে অন্য মাসের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করে রোজা পালন করেছেন বলেও আমার জানা নেই। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৩২)

 বিভিন্ন সময় আশুরার রোজার অবস্থা 
বহু হাদিসে প্রমাণিত যে আশুরার রোজার অবস্থা বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন ছিল। নিচে তা উল্লেখ করা হলো :

রাসুল (সা.) নিজে মক্কায় সেদিন রোজা রেখেছিলেন; কিন্তু তিনি লোকদের তা করতে উৎসাহিত করেননি। আয়েশা (রা.) বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে কুরাইশরা আশুরার রোজা পালন করত এবং আল্লাহর রাসুল (সা.)-ও এ রোজা পালন করতেন। যখন তিনি মদিনায় আগমন করেন তখনো এ রোজা পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দেন। (বুখারি, হাদিস : ২০০২)

রাসুল (সা.) যখন মদিনায় আগমন করলেন, তখন তিনি দেখলেন যে ইহুদিরা আশুরা পালন করছে এবং সেদিন রোজা রাখছে। তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজে রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরও তা করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এত গুরুত্বারোপ করেছিলেন যে লোকেরা তাদের সন্তানদেরও আশুরার রোজা রাখতে উৎসাহিত করত। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০০৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫২৬)

যখন রমজানের রোজা ফরজ হয়ে যায়, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে ওই দিন রোজা রাখার বা না রাখার সুযোগ দিয়েছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথমে আশুরার দিন রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, পরে যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করবে আশুরার রোজা পালন করবে আর যে ব্যক্তি চাইবে ইফতার (ভঙ্গ) করবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০০১)

জীবনের শেষ দিনগুলোতে নবী করিম (সা.) ইহুদিদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ার জন্য বলেছিলেন, আগামী বছর বেঁচে থাকলে শুধু আশুরার রোজা রাখব না; বরং আমি এর সঙ্গে আরেকটি রোজা একত্র করব। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আশুরার দিন রোজা পালন করেন এবং লোকদের রোজা পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবিরা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, ইহুদি ও নাসারারা এই দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইনশাআল্লাহ, আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও রোজা পালন করব। বর্ণনাকারী বললেন, এখনো আগামী বছর আসেনি, এ অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকাল হয়ে যায়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৩৪)

আশুরার দিনে রোজা রাখার হুকুম
উপরোক্ত হাদিসের আলোকে ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ১০ মহররমের রোজা রাখবে, তার সঙ্গে অন্য দিনও রোজা রাখা বাঞ্ছনীয়। তা মহররমের ৯ তারিখ হোক বা ১১ তারিখ। অর্থাৎ আশুরার দিনের রোজার সঙ্গে মিলিয়ে মোট দুটি রোজা রাখা মুস্তাহাব। চাই তা ৯ তারিখে রাখুক বা ১১ তারিখ। যাতে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে সামঞ্জস্য না হয়ে যায়। কেননা তারা শুধু আশুরার দিনেই রোজা পালন করে। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা- ৩৭৫, বাদায়েউস সানায়ে, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা- ৭৯)

কয়টি রোজা রাখবেন
কেউ কেউ মনে করেন, শুধু ১০ মহররমের রোজা রাখা গুনাহ। তাই আশুরার আগে বা পরে রোজা রাখতে হবে; কিন্তু এটি সত্য নয়। কেননা ১০ মহররমের সঙ্গে আরেকটি রোজা একত্র করা ওয়াজিব ও আবশ্যক নয়; বরং উত্তম ও মুস্তাহাব। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.) যে ফজিলত বর্ণনা করেছেন, তা শুধু ১০ মহররমের রোজা রাখার মাধ্যমেই অর্জিত হয়ে যায়। তবে ইহুদিদের অনুকরণ এড়াতে আরেকটি রোজা মিলিয়ে রাখা একটি অতিরিক্ত ফজিলতপূর্ণ ও মুস্তাহাব আমল।

উল্লেখ্য, অনেক ফকিহ ১০ মহররমের রোজাকে শুধু মাকরুহে তানজিহি বলেছেন। তবে বেশির ভাগ ইমামের মতে, এটি মাকরুহে তানজিহিও নয়। কারণ মুসলমানদের অন্তরে শুধু আশুরার দিনে রোজা রাখার দ্বারা ইহুদিদের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা তো দূরের কথা, চিন্তা-ভাবনাও আসে না। অতএব, যে ব্যক্তি আশুরার আগে বা পরে রোজা রাখার সামর্থ্য রাখে, সে যেন তার আগে বা পরে একটি রোজা পালন করে। তবে যার সামর্থ্য নেই বা অন্য কোনো ওজর আছে, সে যেন শুধু আশুরার রোজা রাখে, যাতে সে তার ফজিলতপূর্ণ সওয়াব থেকে বঞ্চিত না হয়। (ফাতাওয়ায়ে কাসেমিয়া, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা- ৫৯৬)

আল্লামা ইউসুফ বানুরী (রহ.) লিখেছেন, আশুরার রোজা তিন ধরনের :

এক. ৯, ১০ ও ১১- তিন দিনই রোজা রাখতে পারবে।

দুই. ৯ ও ১০ বা ১০ ও ১১ তারিখে রোজা রাখা।

তিন. শুধু ১০ তারিখে রোজা রাখা। 

এর মধ্যে প্রথম স্তরটি সর্বোত্তম, দ্বিতীয়টি তার চেয়ে কম এবং তৃতীয়টি সর্বনিম্ন। আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি (রহ.) বলেন, তৃতীয় স্তর যা সর্বনিম্ন, তাকেই ফকিহরা মাকরুহ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। সুতরাং রাসুল (সা.) যে রোজা রেখেছিলেন এবং ভবিষ্যতে ৯ তারিখের রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণ করেছেন, তাকে কিভাবে মাকরুহ বলা যায়? (মাআরিফুস সুনান, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা- ৪৩৭)

মোটকথা ৯ মহররম বা ১১ মহররমের আরেকটি রোজা ১০ মহররম অর্থাৎ আশুরার সঙ্গে একত্র করা উত্তম। তবে কেউ যদি কোনো কারণে শুধু ১০ মহররমের রোজা রাখে, তাহলে তার ফজিলত ও সওয়াব থেকে মাহরুম হবে না।

আল্লাহ তাআলা আমাদের আশুরার গুরুত্ব উপলব্ধি করার এবং তদনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। 

 

FJ
আরও পড়ুন