ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

দেনমোহর পরিশোধ না করে কি স্ত্রীকে স্পর্শ করা যাবে

আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:২১ পিএম

দেনমোহর ইসলামে নারীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। এটি কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত একটি দায়িত্ব ও কর্তব্য, যা স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যম। ইসলামে বিয়ের ক্ষেত্রে দেনমোহর এমন একটি উপহার যা নারীকে মর্যাদা ও নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতীক।

দেনমোহর শুধুমাত্র চুক্তির কাগজে লেখা কোনো সংখ্যা নয়- এটি আদায়যোগ্য একটি হক। ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেনমোহর আদায় করা উত্তম। যদিও তা পরিশোধ না করলেও বিয়ে শুদ্ধ হয়, তবুও স্বামীকে এই পরিশোধের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। ইসলাম এমন কোনো দায়িত্ব আরোপ করেনি, যার বাস্তবায়ন জরুরি নয়।

কিন্তু অনেকে প্রশ্ন করেন, দেনমোহর আদায় না করেই কি স্ত্রীকে স্পর্শ করা বৈধ হবে?

ফুকাহায়ে কেরাম (ইসলামী فقہবিদগণ) এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তারা বলেন, বিয়ের সময় এমন পরিমাণে দেনমোহর নির্ধারণ করা উচিত, যা নগদ পরিশোধ করা সম্ভব হয়। যদিও বিয়ের সময় তা পরিশোধ না করলেও বিবাহ বন্ধন বৈধ হবে। তবে মোহরের পরিশোধের জন্য একটি নির্ধারিত সময় বা চুক্তি থাকা উচিত। যদি কেউ সেটিও না করে এবং দেনমোহর পরিশোধে গাফিল থাকে, তাহলে স্ত্রীর এ অধিকার রয়েছে যে, তিনি নিজেকে স্বামীর কাছে হস্তান্তর (স্পর্শ, সহবাস, আলিঙ্গন প্রভৃতি) থেকে বিরত রাখতে পারেন।

এমন অবস্থায়ও স্বামীকে স্ত্রীর ভরণ-পোষণ (নাফাকা) নিয়মিত প্রদান করতে হবে। কেননা স্ত্রী কোনো অবাধ্যতা বা দাম্পত্য সম্পর্ক অস্বীকারের কারণে নয়, বরং নিজ অধিকার আদায়ের স্বার্থে স্বামীর সঙ্গে ঘর করছে না। এটি শরিয়তসম্মত ও বৈধ।

এ ব্যাপারে কোরআনের নির্দেশনা: আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন-

وَٱلْمُحْصَنَٰتُ مِنَ ٱلْمُؤْمِنَٰتِ وَٱلْمُحْصَنَٰتُ مِنَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلْكِتَٰبَ مِن قَبْلِكُمْ إِذَآ ءَاتَيْتُمُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ

‘আর তোমাদের মধ্যে যারা মুমিন সচ্চরিত্রা নারী, এবং পূর্বে যারা কিতাবপ্রাপ্ত তাদের মধ্যে সচ্চরিত্রা নারীগণ, তাদের বিয়ে তোমাদের জন্য হালাল, যদি তোমরা তাদেরকে তাদের দেনমোহর প্রদান করো বিবাহের জন্য—ব্যভিচারী হিসেবে নয় বা গোপন প্রণয়িনী হিসেবে নয়।’ (সূরা আল-মায়েদা: আয়াত ৫)

এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাবে বলেছেন, নারীকে বিয়ের বৈধতা পাওয়ার জন্য দেনমোহর প্রদান করা শর্ত। যদিও তা বিয়ের আগেই আদায় করতে না পারলেও, তা প্রদান করার নিয়ত ও চুক্তি থাকা আবশ্যক।

এ ব্যাপারে হাদিসের ব্যাখ্যা: নবী করীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই বিষয়ে সতর্ক করে বলেছেন-
مَنْ تَزَوَّجَ امْرَأَةً عَلَى صَدَاقٍ وَهُوَ يَنْوِي أَنْ لَا يُؤَدِّيهِ إِلَيْهَا فَهُوَ زَانٍ
‘যে ব্যক্তি কোনো নারীকে এমন দেনমোহরের ভিত্তিতে বিয়ে করে যে, এরপর সে দেনমোহর পরিশোধ করার ইচ্ছা রাখে না, তাহলে সে ব্যভিচারী হবে।’ (মুসনাদ বজ্জার ৮৭২১)

এই হাদিস থেকে স্পষ্ট যে, দেনমোহর আদায়ের নিয়ত ছাড়া বিয়ে করলে এবং সেই নারীকে স্পর্শ করলে সেটি চরম অন্যায় ও আল্লাহর কাছে প্রতারণার শামিল। এটি কেবল দুনিয়াতে গোনাহ নয়, বরং কিয়ামতের দিন এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে।

স্ত্রীর অধিকার ও অবস্থান: ইসলামী আইন মতে, দেনমোহর আদায় না হলে স্ত্রীর অধিকার রয়েছে-
> নিজেকে স্বামীর নিকট হস্তান্তর না করার
> যৌনসম্পর্ক, এমনকি চুম্বন ও আলিঙ্গন থেকেও বিরত থাকার
> স্বামীর সঙ্গে সফরে যেতে অস্বীকার করার
> এই অধিকার দেওয়ার উদ্দেশ্য, নারীকে মর্যাদার সঙ্গে বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করানো। তার সম্মান ও অধিকার রক্ষা করা।

হানাফি মাজহাব মতে, ‘মোহর আদায় না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে দূরে থাকার অধিকার রাখেন এবং সে অবস্থায়ও স্বামীকে তার ভরণপোষণ বহন করতে হবে।’ (দুররে মুখতার, নাফাকাত অধ্যায়)

দেনমোহর কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়, এটি নারীর ইসলামী ও মানবিক অধিকার। বিয়ের মাধ্যমে স্বামীকে যেমন স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হয়, তেমনি দেনমোহর প্রদান করে তার মর্যাদাকেও স্বীকৃতি দিতে হয়। দেনমোহর আদায়ের পূর্বে স্ত্রী যদি স্বামীর স্পর্শ এড়িয়ে চলে, তবে শরিয়ত তা সমর্থন করে এবং এটিকে তার অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (সা.) নির্দেশ অনুসরণ করাই প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য।

MMS
আরও পড়ুন