ঢাকা
মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

শ্যামনগর উপকূলে খাবার পানির জন্য হাহাকার

আপডেট : ১৫ মে ২০২৪, ১১:৩২ এএম

শ্যামনগর উপকূলে সুপ্রিয় পানির তীব্র সংকট। বেশ কয়েকদিন আগেও তীব্র গরমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের সাতক্ষীরার শ্যামনগরে নিরাপদ খাবার পানিসহ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারযোগ্য পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছিল। এখন বৃষ্টির মাঝেও সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

উপকূলীয় এ উপজেলার সর্বত্রই এক ফোঁটা পানির জন্য এখন রীতিমতো হাহাকার চলছে। চারদিকে পানি আর পানি। তবে সবটাই লবণপানি। নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরাও পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে মাইলের পর মাইল রাস্তা পাড়ি দিচ্ছেন। অনেকে পুকুরের কাদামিশ্রিত ও লবণযুক্ত পানি পান করতেও বাধ্য হচ্ছেন।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থায় ৪০ শতাংশ মানুষ পানির সংকটে থাকে। তবে গ্রীষ্মের এই তীব্র তাপদাহের খরাতাপে এ এলাকায় ৫০-৬০ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে। সরকারিভাবে এই তথ্য দেওয়া হলেও বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ বলছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক  স্থানীয়রা।

এ উপজেলার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, স্থানীয়দের পানি পান করাসহ দৈনন্দিন কাজের জন্য নির্ভর করতে হয় পুকুর ও বৃষ্টির পানির ওপর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, চিংড়ি ঘেরে উঁচু বাঁধ না দেয়া, নদী প্রবাহ আটকে দেয়া, পুকুর ভরাট, খাল বেদখলের কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষগুলো নিরাপদ পানির তীব্র সংকটের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছেন।

শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ১ হাজার ৯৪৯টি গভীর, ৪৯১টি অগভীর, ৫০০টি এসএসটি ও ৪৪১টি ভিএসএসটি নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে আটটি গভীর, ১২৯টি অগভীর, ১৬টি এসএসটি ও ৪৪টি ভিএসএসটি নলকূপ কয়েক বছর ধরে অকেজো পড়ে আছে।

প্রাকৃতিক উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়া, সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা জলাধারগুলো চাহিদা পূরণে সক্ষম না হওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান এ সমস্যা দৈনন্দিন ও প্রাত্যহিক জীবনের ওপর প্রভাব ফেলছে। টিউবওয়েলের পানি মাত্রাতিরিক্ত লবণ ও আয়রনযুক্ত। এই জনপদের শতাধিক গ্রামে একই অবস্থা।

উপকূলীয় এ অঞ্চলের গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, কৈখালী ও রমজাননগর এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব এলাকার বেশিরভাগ খাল ও পুকুর শুকিয়ে যাওয়ায় কোথাও গোসল এবং খাবারের পানি মিলছে না। লোকজন আর্সোনিকযুক্ত নলকূপ, নোংড়া পুকুরের পানি পান করছে। এসব পানি পান করে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে ভুগছে।

প্রতিবারের মতো এবারও বর্ষা মৌসুম শেষে উপকূলীয় জনপদে লবণাক্ততার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি পানীয় জলের সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। জানা যায়,  ২০০৯ সালের প্রলয়ংকরী আইলার পর থেকে এই এলাকার প্রাকৃতিক পানির জলাধারসহ অসংখ্য গভীর, অগভীর নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পানির সংকট তীব্রতর হয়ে উঠেছে।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মানুষ প্রচণ্ড গরমে পানিবাহিত রোগ যেমন ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

কৈখালী ইউনিয়নের বৈশখালী এলাকার খোকন আহমেদ দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন বলেন, তীব্র তাপদাহে এলাকার সব পুকুরের পানি শুকিয়ে গেছে। অন্যদিকে নলকূপের পানিও লোনা। সরকারি-বেসরকারি যেসব খাবার পানির উৎস ছিল সেগুলো সংস্কার করার অভাবে সংকট বেড়েছে। যা এই এলাকার মানুষের জনজীবন চরম হুমকিতে ফেলেছে।

গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের আব্দুস সামাদ, শামসুজ্জামান লালন ও রুহুল আমিনসহ বেশ কয়েকজন জানান, এই এলাকার পানি লবণাক্ত। সরকারি অনেক জায়গা থাকলেও সরকারি কোনো পুকুর বা জলাধার না থাকায় প্রতিবছর দুই থেকে তিন মাস বিশুদ্ধ খাবার পানির কষ্টে জীবন কাটাতে হয় আমাদের। এই তীব্র গরমে আমাদের এ এলাকায় খাবার পানি ও দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারযোগ্য পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। আমরা এর একটি স্থায়ী সমাধান চাই।

স্থানীয় পরিবেশকর্মী রুহুল আমিন বলেন, গ্রীষ্মের দাবদাহ বাড়ার সাথে সাথে এই উপকূলীয় অঞ্চলে খাবার পানির সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে উল্লেখ করে তিনি জানান, সরকারি-বেসরকারিভাবে এ এলাকায় পানির ব্যবস্থা না করলে এখানকার মানুষের বেঁচে থাকা দায় হয়ে যাবে। তিনি এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান এবং জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সরকার ও সকল উন্নয়ন সংস্থাকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা তরুণ জলবায়ুকর্মী শাহিন আলম বলেন, কোনো এলাকায় খাওয়ার পানির সংকট দেখা দিলে তা শুধু খাওয়ার পানির সমস্যায় আটকে থাকে না। আরও বড় বড় সংকটের কারণ হয়ে ওঠে। স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। সামাজিক অস্থিরতাও তৈরি হয়। এই দিকগুলো সরকারের নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া দরকার। সংকটটি সাময়িক নয়, শিগগিরই প্রাকৃতিকভাবে এর সমাধান হবে, তেমন কোনো লক্ষণও নেই।

তিনি বলেন, সুতরাং এই সংকট থেকে এখানকার মানুষকে কীভাবে নিষ্কৃতি দেওয়া যায়, তা গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে। বর্তমানে বৃষ্টির পানি জলাধারে সংরক্ষণ করে ও পুকুরের পানি ফিল্টারিং করেই মূলত এলাকাবাসী পানির চাহিদা মেটাচ্ছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সেই পানির পরিমাণ খুবই কম। সরকারিভাবে যদি বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য বড় বড় জলাধার তৈরি করে এবং পানি শোধনের বড় কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, তাহলে তাদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতে পারে। আশার কথা হচ্ছে সরকারিভাবে এলাকাবাসীর মধ্যে ট্যাংক সরবরাহ করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে উদ্যোগ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখানে ওই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে। এই কার্যক্রম জোরদার করা গেলেও জনদুর্ভোগ অনেকখানি কমে যাবে।

শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপে পানি কম উঠছে। শুধুমাত্র দুর্যোগকালীন সময়ে সরকারিভাবে দুর্গতদের মধ্যে খাওয়ার পানি বিতরণ করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, পানি সমস্যা দূরীকরণে শ্যামনগরে জনস্বাস্থ্য বিভাগের পিএসএফ, আরডব্লিউএইচ (রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং), গভীর ও অগভীর নলকূপ, আরও (রিভার্স অসমোসিস), পুকুর, দিঘি, মার (ম্যানেজ একুইফার রিসার্চ) মিলিয়ে প্রায় ৮ হাজার পানির উৎস রয়েছে। তবে বৃষ্টির অভাব, বন্যায় এলাকায় লবণ পানি ঢুকে যাওয়া ও পুকুর, জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় আরডব্লিউএইচ ও পিএসএফ ঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে পানির সংকট বেড়েছে।

MHR
আরও পড়ুন