সারাদেশে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে যুগান্তকারী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের সোপান তৈরি করে অনেকটাই সফলতার মুখ দেখতে যাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন এই কর্মপরিকল্পনা খাতটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে বলে খাত বিশেষজ্ঞদের ধারণা। নতুন এই উদ্যোগ নিয়ে আশাবাদী মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা।
সারাদেশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়। এদিকে বর্ষাকালে প্রচুর মৌসুমী বৃষ্টিপাত এবং উপযোগী মাটি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাংলাদেশকে মৎস্য উৎপাদনের এক অপূর্ব লীলাভূমিতে পরিণত করেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিগত এক মাসে (আগস্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বর) যে উদ্যোগ নিয়েছে সেখানে সফলতা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের মাছ চাষে এক নীরব বিপ্লব ঘটবে। মৎস্য বিশেষজ্ঞ মনে করছেন এতে দেশে আমিষের অভাব পূরণ হবে।
সম্প্রতি মৎস্য অধিদপ্তর এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সকল স্তরের কর্মকর্তার নিয়ে বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যৎ করণীয় এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা বিষয়ক মতবিনিময় করা হয়। গত ৫ আগস্ট পরবর্তী সরকারের অদক্ষতা একই সঙ্গে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বর্তমান সরকারের দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এসময় প্রকল্প বাস্তবায়ন বিষয়ে একাধিক সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় বিশ্বব্যাংকের নিকট হতে গৃহীতব্য ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। তাছাড়া লাইভ স্টক এন্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত ৩টি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় স্লটার হাউস নির্মাণ কার্যক্রম বাদ দিয়ে প্রায় ২৯৭ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে। এইসব প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে এই বিপুল অর্থের সাশ্রয় করা হয়েছে।
এদিকে গত ২৪ আগস্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সচিব, মৎস্য অধিদপ্তর এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকগণ সরেজমিন কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বন্যা উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন কালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের খামারিদের সাথে মতবিনিময় করা হয়। বন্যায় তাদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে দ্রুত পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হয়।
বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন বিষয়ে গত ২৫ আগস্ট মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর/সংস্থার প্রধান কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে এবং ২৮আগস্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আন্ত:মন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। আন্ত:মন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্তের আলোকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, ঋণের কিস্তি স্থগিত করা, মৎস্য ও পশু খাদ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস,দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান, বিদ্যুতে ভর্তুকি প্রদানের জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথাক্রমে অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিদ্যুৎবিভাগ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে বন্যা উপদ্রুত এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উদ্যোগে ১৮৮ ম্যাট্রিক টন দানাদার পশু খাদ্য, ৬৫ মেট্টিক টন খড় ও ৯৬ মেট্টিক টনসাইলেজ ও ৪৫ হাজার উন্নত জাতের ঘাসের কাটিং বিতরণ করা হয়। জরুরি ভিত্তিতে ঔষধ সরবরাহ ও টিকা প্রদানসহ প্রায় ২০ হাজার গবাদি পশু ও ২ লক্ষাধিক হাঁস মুরগি চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়াও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় হতে উপদ্রুত এলাকায় পশু খাদ্য ক্রয় বাবদ ৫১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় হতে অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রদানের বিষয়ে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
মাছ, মাংস, দুধ ও ডিমের মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সাথে মতবিনিময় সভা আয়োজন করা হয়েছে। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সাথে আলোচনাক্রমে ডিম, দুধ, মুরগির দাম কমানোর জন্য বিশেষ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, একই সঙ্গে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।দেশের মানুষ যাতে সুলভ মূল্যে ইলিশ খেতে পারে সে জন্য রপ্তানি না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ইলিশ মাছের পাচার রোধ ও মূল্য সহনশীল রাখার জন্য আড়তদার,ট্রলার মালিকসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সাথে সভা করা হয়। তাছাড়া ব্যবসায়ী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে মতবিনিময় করে সুলভ মূল্যে ইলিশের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
জানা গেছে, মাঠ পর্যায়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ নিয়ে কর্মসূচি পরিচালনা কারী বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় করা হয়েছে। মৎস্য ও গবাদি পশুর জাত রক্ষা এবং যারা এই কাজের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন সে সকল প্রান্তিক খামারিদের সমস্যা এবং তা উত্তরণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সভায় উপস্থাপিত প্রস্তাবসমূহ যাচাই করে প্রকল্প প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বন্যা উপদ্রুত এলাকার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খামারিদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের জন্য বিভিন্ন এনজিও, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এবং দপ্তর/সংস্থার প্রধানদের অংশগ্রহণে মতবিনিময় সভাঅনুষ্ঠিত হয়। সভায় এনজিওদের প্রয়োজনীয় সহায়তা ও তথ্য প্রদানের জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এছাড়াও অধীন দপ্তরসমূহের পদোন্নতিসহ পদায়নের কার্যক্রম গতিশীল করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের ২৫ জন কর্মকর্তাকে সহকারী পরিচালক পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। সমাপ্ত ও চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তর বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে উত্থাপিত দাবি সমূহ বিবেচনার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। বন্যা দুর্গতদের সহায়তার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং অধীন দপ্তর/সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১ (এক) দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ নব্বই লাখ ছিয়ানব্বই হাজার নয়শত চুরাশি টাকার চেক প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে জমা দেওয়া হয়। সবমিলিয়ে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন হলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে অচিরেই নীরব বিপ্লব ঘটবে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মির্জা ফরিদা আখতার মৎস্য প্রাণিসম্পদ খাতের ভিশন ও মিশন বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, সকলের জন্য নিরাপদ,পর্যাপ্ত ও মানসম্মত প্রাণিজ আমিষ নিশ্চিতকরণ আর মৎস্য ও প্রাণিজ পণ্যের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ করাই আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলে মন্তব্য করেন তিনি।
