ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

যমুনায় ট্রেনের হুইসেল বাজবে কাল

আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৫:২০ পিএম

যমুনার বুকে নৌ চলাচল স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু সেই নদীরে উপরে গড়ে উঠবে সেতু, আর সেই সেতু দিয়ে রেল চলবে এমনটি ছিল স্বপ্নের অতীত। কিন্তু সেই স্বপ্ন দৃশ্যমান হচ্ছে মঙ্গলবার (১৮ মার্চ ) থেকে। 

যমুনার উপর দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে চলবে ট্রেন। চলাচলের সময় হয়তো অনেকেরই মনে পড়বে    ছড়াটি:......‘হাজার মাইল পথ মাড়িয়ে ছুটে চলে রেলগাড়ি/বন বনানী পাহাড় নদী এক নিমেষে যায় ছাড়ি/চলার গতি বাড়ায় কমায় সকল নিয়ম মেনে/যাত্রী উঠয়ে যাত্রী নামায় গতির লাগাম টেনে’।

অন্তর্বর্তী সরকার মেঘা প্রকল্প যমুনা রেল সেতু চালু হচ্ছে ১৮ মার্চ। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের গ্রহণ করা ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলসেতু নির্মাণের মেঘা প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৬ সালে। প্রকল্পের শুরুতে এই সেতুর নামছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের ডিসেম্বরে সেতুর নাম পাল্টে যমুনা রেল সেতু করা হয়েছে। 

১৮ মার্চ সকাল ১০টায় সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদ রেল স্টেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম। এ সময় রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেনসহ রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন। উদ্বোধন শেষে সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে টাঙ্গাইল-ইব্রাহিমাবাদ রেল স্টেশনে ব্রিফিং করবেন সচিব। 

বুধবার (১৯ মার্চ) থেকে বাণিজ্যিকভাবে এই সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সচিব, মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের যাওয়া ও আসার জন্য ধূমকেতু এক্সপ্রেস প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সকাল ৬টায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনটি ছেড়ে যাবে। যমুনা রেলসেতু উদ্বোধনের পর বিশেষ করে দেশের পশ্চিমাঞ্চলবাসীদের মধ্যে ট্রেন চলাচল বৃদ্ধি পাবে। যমুনা নদীর দুই তীরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বৃদ্ধি পাবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। 

জানা গেছে, যমুনা রেলসেতু নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। তা বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা।  পুরাতন সেতু দিয়ে রেল চলাচলে ব্যাঘাত ঘটার ফলে নতুন করে রেলসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুরাতন সেতুতে যমুনা  নদী পারাপারে সময় লাগতো ২০ থেকে ২৫ মিনিট সেখানে নতুন সেতু নির্মিত হওয়ায় সময় লাগবে মাত্র ৩ মিনিট।  তবে ভাড়ার বিন্যাস ঘটেছে। আগের ভাড়ার চেয়ে ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই সেতু ব্যবহার করে চলা ট্রেনের আসন  ভেদে ভাড়া বাড়বে ৪৫ থেকে ১৬০ টাকা পর্যন্ত। এই ভাড়া ১৯ মার্চ থেকেই কার্যকর হবে বলে রেলওয়ে সূত্রের খবর।   

রেলওয়ে সূত্র বলছে, যমুনা রেল  সেতুটির দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। কিন্তু সেতুটিকে ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে। অর্থাৎ সেতুটির প্রতি কিলোমিটার দূরত্বকে ২৫ কিলোমিটারে বাড়িয়ে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। অবশ্য যমুনা সড়কসেতু দিয়ে ট্রেন চলার সময়ও প্রতি কিলোমিটারকে ১৭ কিলোমিটার ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল। নতুন সেতুতে প্রতি কিলোমিটারে আট কিলোমিটার বেড়েছে। বড় সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য টোল আদায় করা হয়। রেলওয়ে সেতুর টোল যাত্রীদের টিকিটে সরাসরি যুক্ত করে দেয়। আর এই বাড়তি অর্থ যুক্ত করার নির্দিষ্ট একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে রেলওয়ে। একে রেলওয়ে ‘পন্টেজ চার্জের’ জন্য বাড়তি দূরত্ব বলছে, যা ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসছে।

রেলওয়ে সূত্রের খবর, নতুন সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হিসেবে বাড়তি ভাড়া আদায়ের রেওয়াজ ব্রিটিশ আমল থেকে চালু আছে। এত দিন কোন সেতুতে কত বাড়তি আদায় করা হবে এর সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম ছিল না। পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চালুর সময় সেতুর বাড়তি ভাড়া হিসাবের ক্ষেত্রে নতুন করে চালু বড় সেতুর প্রতি কিলোমিটারকে ২৫ কিলোমিটার ধরে ভাড়া নির্ধারণের নিয়ম চালু হয়। নতুন যমুনা সেতুতে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। 

তবে রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, তারা সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে ১০০ কি.মি.। রেলওয়ে সূত্র বলছে, বর্তমানে রেলে কিলোমিটারপ্রতি এসি শ্রেণির ভিত্তি ভাড়া ১ টাকা ৯৫ পয়সা। নন-এসি শ্রেণির ভিত্তি ভাড়া ১ টাকা ১৭ পয়সা। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত করা হয়। এছাড়া আন্ত: নগর ট্রেনে বিরতিহীন চার্জ যুক্ত করা হয় আরও ১০ শতাংশ। দেশে লোকাল, মেইল,কমিউটার ও আন্তঃনগর এই চার ধরনের ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে ভাড়ার হার কিছুটা কমবেশি আছে। আন্তঃনগর ট্রেনেও বিভিন্ন শ্রেণি রয়েছে। 

এগুলো হলো শোভন-চেয়ার, এসি চেয়ার, এসি সিট ও এসি বার্থ (শুয়ে যাওয়ার আসন)। লোকাল ট্রেনে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা। আন্ত-নগরে তা ৩৫ টাকা। তবে সেতু ও উড়ালপথ থাকলে সর্বনিম্ন ভাড়া বাড়ে। রেলের ভাড়া প্রতিটি আসনের ভাড়া নির্ধারণে এসব হিসাব আমলে নেওয়া হয়। ট্রেনের টিকিট বিক্রি ওয়েব সাইটে দেখা গেছে, কাল ১৮ মার্চ ঢাকা থেকে রাজশাহী যেতে ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনে শোভন চেয়ার শ্রেণির আসনের ভাড়া ৪০৫ টাকা, স্নিগ্ধা (এসি চেয়ার) শ্রেণির আসনের ভাড়া ৭৭১ টাকা ও এসিসিট শ্রেণির আসনের ভাড়া ৯২৬ টাকা দেখা গেছে । কিন্তু একই ট্রেনে ১৯ মাচের্ শোভন চেয়ার শ্রেণির আসনের ভাড়া ৪৫০ টাকা, স্নিগ্ধা (এসি চেয়ার) শ্রেণির আসনের ভাড়া ৮৬৩ টাকা ও এসি সিট শ্রেণির আসনের ভাড়া ১ হাজার ৩৫ টাকা  দেখানো হয়। একইভাবে লালমনিরহাট এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস, বনলতা, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস,সিল্কসিটি, পদ্মা, নীলসাগর, চিলাহাটি এক্সপ্রেস, চিত্রা এক্সপ্রেস, একতা,দ্রুতযান, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, বুড়িমারী এক্সপ্রেসসহ সব ট্রেনেরই ভাড়া বাড়ছে। মূল সেতু পার হতে ট্রেনে লাগবে দুই থেকে তিন মিনিট। আর দুই পারের স্টেশন সয়দাবাদও ইবরাহিমাবাদের মধ্যে দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এই অংশ পার হতে সাত মিনিটের বেশি লাগবে না বলে রেল সূত্র জানায়।

১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর সড়কসেতু চালু হয়। ওই সেতুতে শেষ মুহূর্তে রেল যুক্তকরা হয়। এর মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তবে ২০০৬ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেওয়ার পর ট্রেন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ঘণ্টায় সেতু দিয়ে ২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করত। নতুন রেলসেতু নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৬ সালে। 
রেল কর্তৃপক্ষ বলছেন, বিগত সময়ে যমুনা সড়কসেতু দিয়ে প্রতিদিন ৩৮টি ট্রেন চলাচল করেছে। চাহিদা থাকার পরও লাইন ও  সেতুর সক্ষমতা না থাকায় ট্রেন বাড়ানো সম্ভব হয়নি। এসময় সেতুর দিকে লক্ষ্য রেখে ভারী মালবাহী ট্রেন চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। নতুন সেতুর কারণে সেই বাধা অপসারিত হবে। 

রেল সূত্রের দাবি, এই প্রকল্পের আওতায় সেতুর দুই প্রান্তে সাড়ে সাত কিলোমিটার দুই লাইনের সংযোগ রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় ৩১ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হয়। এছাড়া রেলওয়ে সেতু জাদুঘর নির্মাণসহ আরও কিছু কাজ যুক্ত করা হয়। প্রকল্পের মূল কাজের একাংশ করেছে জাপানের ওবাইয়েশি কোম্পানির নেতৃত্বাধীন ঠিকাদারদের একটি জোট। আরেকটি  ওই জাপানের ইশিকা ওয়াজিমা-হারিমা হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি ও সুমিতো মোমিটসুই কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। তারা  যৌথভাবে এই প্রকল্প সম্পন্ন রয়েছে।  আবার প্রকল্পের পরামর্শকও ছিল জাপানের একটি প্রতিষ্ঠান। 

 

MN
আরও পড়ুন