ঢাকা
মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

বজ্রপাত যেন এক সাক্ষাৎ মৃত্যু, ৭২ শতাংশই কৃষক

আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:০৫ এএম

বাংলাদেশে বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মূলত আবহাওয়ার ধরণে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাত বেড়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বলছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে বজ্রপাতে মানুষ মারা যাবার সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। বজ্রপাতে মানুষ মারা যাওয়ার সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি বজ্রপাতের প্রবণতাও বেড়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন দেশের কিছু জায়গা বজ্রপাত-প্রবণ। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চল অন্যতম। গ্রীষ্মকালে এ অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকায় এ পরিস্থিতির তৈরি হয়। শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সিলেট, সুনামগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জের পৃথকস্থানে বজ্রপাতে ৮ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে।

পিয়ার-রিভিউ জার্নাল হেলিয়ন এ প্রকাশিত গবেষণা ‘বাংলাদেশে বজ্রপাত পরিস্থিতির ওপর জিআইএস-ভিত্তিক স্থানিক বিশ্লেষণ’ এ বলা হয়েছে, বেশিরভাগ প্রাণহানি বর্ষা পূর্ববর্তী মৌসুম এবং বর্ষা ঋতুতে ঘটে, যার মধ্যে উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।

এতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে আবহাওয়ার ধরণ ও বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ এবং ঋতু পরিবর্তনের মতো ঘটনা ঘটছে। এ কারণেই বজ্রপাত বাড়ছে।

মার্চ মাসে প্রকাশিত এ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতের ফলে ২ হাজার ১৪২ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ৫৩৮ জন। 

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে গড়ে ৩০০ মানুষ মারা যায়। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বজ্রপাতের কারণে বছরে ২০ জনেরও কম মৃত্যু ঘটে।

বাংলাদেশ ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর মে মাস পর্যন্ত বজ্রপাতে অন্তত ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১০ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১২৩ জন। গত বছর বজ্রপাতে মারা গেছেন ৩৫০ জন।

গবেষণায় ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বজ্রপাত সংক্রান্ত ঘটনা মূল্যায়নের জন্য আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের নিয়ার-রিয়েল টাইম মিশন থেকে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ড এবং নাসার লাইটনিং ইমেজিং সেন্সর ডেটা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে।

বজ্রপাতে মৃত্যুর ৭২ শতাংশই কৃষক: দেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০০ জন মানুষ মারা যাচ্ছে বজ্রপাতে। এদের ৭২ শতাংশই কৃষক। মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ২০১৬ সাল থেকে সরকারের পক্ষ থেকে তা দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এতে মৃত্যু থেমে নেই।

বজ্রপাত কখন হয়: আন্তর্জাতিকভাবে বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করছেন ড. আশরাফ দেওয়ান। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক দেশ বলেন, আমাদের দেশে সাধারণত বিকেল থেকে রাত এবং ভোররাত থেকে ভোর, এই সময়ে বজ্রপাত হয়ে থাকে। মূলত সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত হলো বজ্রপাতের আদর্শ সময়। সাধারণত পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম, উত্তর-পূর্ব, উত্তর এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে দেশে বজ্রমেঘগুলো প্রবেশ করে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, ‘বজ্রমেঘ বাতাসে ভর করে প্রবাহিত হয়। তাই বাতাসের গতিবেগ যত থাকে ততবেগেই বজ্রমেঘগুলো প্রবাহিত হয়ে থাকে। সাধারণত দেশের বাইরে থেকে আমাদের দেশে বজ্রমেঘগুলো প্রবেশ করে। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় নিয়ে থাকে।’

দেশে সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসে প্রায় ৫৯ শতাংশ, আর মৌসুমি বায়ু আসার সময়, অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৬ শতাংশ বজ্রপাত হয়। তবে মোট বজ্রপাতের প্রায় ৭০ শতাংশ হয় এপ্রিল থেকে জুনে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশে আসার আগের দুই মাসে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে বজ্রপাতের প্রকোপ অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক বেশি হয়। বর্ষাকালে রাঙ্গামাটি, সুনামগঞ্জ ও চট্টগ্রামে বজ্রপাত হয়। এ ছাড়া শীতকালে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট আর শীতের শেষে রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়।

বজ্রপাতে কারা বেশি মারা যাচ্ছে: খোলা আকাশের নিচে থাকলেই বজ্রপাতে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। আর খোলা আকাশের নিচে থাকে আমাদের শ্রমজীবী মানুষ ও কৃষকরা। ড. আশরাফ দেওয়ান বলেন, ‘আমাদের দেশে ভোরের দিকে দেশের হাওর (সিলেট, শ্রীমঙ্গল, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা) অঞ্চলের কৃষকরা মাঠে কাজ করতে যায়। তখন ওই এলাকায় বজ্রপাতে কৃষকরা বেশি মারা যায়। এ ছাড়া মাছ ধরতে যারা বাইরে যায়, কিংবা সন্ধ্যার সময় কাজে বাইরে থাকে তারাই বজ্রপাতে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকে।’

আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা, বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ, নদীর চর এলাকা, নদীর আইল বা সাগরের পাড় এলাকায় যেখানে উঁচু কোনো স্থাপনা বা বৃক্ষ নেই সেসব এলাকায় বজ্রপাতের সময় মানুষ থাকলে তারা মৃত্যুঝুঁকিতে থাকে।

বজ্রপাত কতক্ষণ স্থায়ী হয়: বজ্রপাত মূলত ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। আবুল কালাম মল্লিক বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, দেশে মূলত বর্ষার আগ মুহূর্তে বেশি বজ্রপাত হলেও মে মাসে সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এ মাসে গড়ে ১৩টি বজ্রমেঘ সৃষ্টি হওয়ার কথা।

মৃত্যুহার কমানোর উপায় কি: পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ৮০ লাখ বজ্রপাত সৃষ্টি হয়ে থাকে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও বজ্রপাতে একসময় অনেক মানুষের মৃত্যু হতো। কিন্তু বজ্রনিরোধক খুঁটি বা পোল স্থাপন ও মানুষকে সচেতন করে মৃত্যুহার কমিয়ে আনা হয়েছে। তাই বজ্রপাতে মৃত্যুহার কমাতে বজ্রপাতের পূর্বাভাসকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। বর্তমান প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা আগে থেকেই জানি কোন এলাকায় কোন সময় বজ্রপাত ঘটবে। অর্থাৎ কোনো এলাকার ওপর দিয়ে বজ্রমেঘ প্রবাহিত হবে কি না, তা কিন্তু বলা যায়।

এ বিষয়ে ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, আমরা রাডার সিস্টেমের মাধ্যমে বজ্রপাতের আগাম ঘোষণাগুলো স্থানীয় মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি। এ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া, রেডিও, টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন বিরতি কিংবা মিডিয়ায় ঘোষণার মাধ্যমে বজ্রপাতের সময় জানিয়ে দিতে পারি। এতে স্থানীয়রা সচেতন হয়ে বজ্রপাতের ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট সময় ঘরে অবস্থান করবে।

SM/FI
আরও পড়ুন