বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান অর্থনীতির দেশ। এখানে কৃষককে প্রতিনিয়ত মাঠে কাজ করতে হয়। জেলেকে ধরতে হয় মাছ। একই সাথে গ্রামের অনেক মানুষকে ক্ষেত খামারেই কাজ করতে হয় দিনের অনেকটা সময় জুড়ে। গ্রামের এসব কৃষক ও অন্যান্য পেশার মানুষদের অনেকেই ক্ষেত-খামারে, বাড়ি কিংবা উঠানে বজ্রপাতে প্রাণ হারান। আহতের পরিসংখ্যানও কম নয়।
ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য মতে, শুধু মে মাসেই বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ৭৬ জনের। বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে সরকার নানা প্রকল্প গ্রহণ করলেও সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি। সরকারি এসব প্রকল্পের ফলে কমেনি মানুষের মৃত্যুও।
বিশেষজ্ঞ ও গবেষকগণ বলছেন, বজ্রপাতে যে শ্রেণির মানুষ মারা যান ও আহত হন তাদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে। তাদের সুরক্ষা দিতে কাজ করতে হবে। তবেই সমস্যার সমাধান হবে৷
ঢাকাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যমতে, চলতি বছরের মে মাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৭৬ জন মানুষ বজ্রপাতে মারা গেছেন। প্রতিষ্ঠানটির কো-অর্ডিনেটর মেহেরুন নেসা দৈনিক খবর সংযোগকে জানান, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ১০৬ জন মানুষ বজ্রপাতে মারা যান। এর মধ্যে মে মাসেই মারা গেছেন ৭৬ জন। এছাড়া ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১ জন, মার্চ মাসে ৯জন ও এপ্রিল মাসে ২০জন মানুষ মারা গেছেন।
মেহেরুন নেসা আরও জানান, দেশে ২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে ৩ হাজার ৮ শত ৭০জন মানুষ মারা গেছেন।
এর মধ্যে ২০২০ সালে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান। ২০২০ সালে বজ্রপাতে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ৩৮১ জন জন, যার ৮১ জনই ছিল শিশু।
মেহেরুন নেসা জানান, ২০১৬ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে আহত হয়েছেন ৯৯৫ জন।আর ২০২৪ সালের মে মাসে বজ্রপাতে আহত মানুষের সংখ্যা ৫৯ জন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৮৪ লাখের বেশি বজ্রপাত হয়। এসব বজ্রপাতের ৭০ ভাগই ঘটে এপ্রিল মাস থেকে জুন মাসের মধ্যে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে বজ্রপাতে মৃত্যু হয় ৩০০ জনের। এর মধ্যে ৭০ ভাগ মাঠে থাকা, সাড়ে ১৪ ভাগ বাড়ি থেকে ফেরার পথে এবং ১৩ ভাগ মানুষ মাছ শিকারের সময় মারা যান।
তালগাছ প্রকল্প বাতিল:
বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে সরকার যেসব প্রকল্প গ্রহণ করেছে তার কোনোটি ব্যর্থ হওয়ায় বাতিল করা হয়েছে, আবার কোনটির সুফল ভোগ করার জন্য প্রযুক্তির যে সহজলভ্যতা প্রয়োজন তা না থাকায় সুফল পাচ্ছে না মানুষ।
বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে ২০১৭ সালে একটি প্রকল্পের আওতায় ১০ লাখ তালগাছের চারা ও ৩৫ লাখ তালের আঁটি রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০১৭ সালে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর ও বাজিতপুরে ৫ হাজার তালের আঁটি লাগানো হয়। এছাড়াও বরিশালের হিজলার বিভিন্ন ইউনিয়নে লাগানো হয় প্রায় ১৫ হাজার তাল গাছের চারা। প্রকল্পের আওতায় রংপুর বিভাগের ৬টি উপজেলায় ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এক লাখ ৪ হাজার ৭শত ৬৭ টি চারা রোপণ করা হয়।
এভাবে এই প্রকল্পের আওতায় যেসব জায়গায় তাল গাছের চারা ও তালের আঁটি লাগানো হয়েছিল সেগুলো পরে অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ২০২২ সালে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।
তালগাছের চারা ও আঁটি লাগানোর প্রকল্পটি সম্পর্কে সে সময় তৎকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা: এনামুর রহমান বলেছিলেন, একটি তালগাছ বড় হতে ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় লাগে। দীর্ঘসূত্রিতার ফলে বিষয়টি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান মনে হচ্ছে না। ৩৮ লাখের মত তাল গাছের চারা ও আঁটি লাগানোর পর দেখা গেল অযত্নে মারা যাচ্ছে। তাই প্রকল্পটি বাতিল করেছি।
লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর প্রকল্প:
২০১৭ সালে বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ সময় বজ্রপাতের পূর্বাভাস জানতে ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাডার (লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর) বসানো হয়। বলা হয়েছিল, বজ্রপাত শুরু হওয়ার ১৫ মিনিট পূর্বেই মানুষকে বজ্রপাত সম্পর্কে তথ্য জানিয়ে দেওয়া যাবে। সরকারের সে প্রকল্পটিও বিফলে চলে গেছে।
মার্কিন গবেষণা সংস্থা নাসার সহযোগিতায় বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর বজ্রপাত সম্পর্কে আগাম তথ্য পেতে 'হাই ইমপ্যাক্ট ওয়েদার অ্যাসেসমেন্ট' নামে একটি প্রযুক্তি চালু করেছে যার মাধ্যমে বজ্রপাত সম্পর্কে ৫৪ ঘণ্টা আগেই তথ্য পাওয়ার কথা। কিন্তু বেশিরভাগ সময় যেসব মানুষ বজ্রপাতের শিকার হন সেসব মানুষের কাছে এসব প্রযুক্তি সহজলভ্য না হয় এগুলোর সুফল তারা ভোগ করতে পারছেন না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রকল্প:
বজ্রপাত থেকে কৃষকদের সুরক্ষা দিতে ‘হাওরাঞ্চলে কৃষকদের জীবন সুরক্ষায় বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন’ নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর।
২০২২ সালে নেওয়া ২৩১ কোটি টাকার এই প্রকল্পের আওতায় হাওরাঞ্চলের সাত জেলার ৫৮ উপজেলায় ১০০ থেকে ১২০ বর্গমিটার ব্যাসার্ধের ১৬টি ‘আর্লি স্টিমার ইমিটার (ইএসই)’ নামের বজ্রনিরোধক যন্ত্র বসানো হবে।
পাশাপাশি ‘আর্থ নেটওয়ার্কস লাইটিং অ্যান্ড সিভিয়ার ওয়েদার আর্লি ওয়ার্নিং সল্যুশন’ সিস্টেমের মাধ্যমে মোবাইল অ্যাপ, ভয়েস ও খুদে বার্তার মাধ্যমে স্থানীয়দের সতর্কবার্তা দেওয়া হবে। কৃষকদের প্রযুক্তির অভাবে এই প্রকল্পের সুফল পাওয়া নিয়েও সংশয় রয়েছে।
বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নেয়া প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে সচিব মো.কামরুল হাসান দৈনিক খবর সংযোগকে খুব বেশি কিছু জানাতে পারেননি।
বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে মানুষকে তারা সচেতন করছেন, সে বিষয়টি তিনি তার মন্তব্যে বারবার তুলে ধরেন । পাশাপাশি এ নিয়ে প্রকল্প পাশের অপেক্ষায় রয়েছে বলেও জনান সচিব মো. কামরুল হাসান৷
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিজাস্টার সায়েন্স এন্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে মানুষকে গণমাধ্যমের মাধ্যমে সচেতন করতে হবে৷ নানা উপায়ে কৃষককে বজ্রপাত সম্পর্কে জানাতে হবে।
'তবেই কৃষক সচেতন হবেন। তখন মৃত্যুও ঠেকানো যাবে,' যোগ করেন তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, কৃষকদের কথা ভাবতে হবে৷ গরীব মানুষের সমন্বয়ে যতদিন একটি জবাবদিহিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা গড়ে না উঠছে ততোদিন এসব সমস্যার সমাধান হবে না।
তিনি বলেন, যত মানুষ বজ্রপাতে মারা যান তার চেয়ে ৩ গুন বেশি মানুষ বজ্রপাতে আহত হন। এসব আহত মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করা দরকার। সরকার এসব মানুষদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারে।
গওহার নঈম ওয়ারা আরও বলেন, বজ্রপাতে আহত মানুষদের অনেকেই কানে শোনেন না, কাজ করতে পারেন না। এসব মানুষকে নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে।
