উন্নত বিশ্বে নিরাপদ ও আনন্দদায়ক যাত্রার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হচ্ছে রেল। অথচ আমাদের দেশে রেলকে নিয়ে নানা ধরনের গল্প কেচ্ছা রয়েছে। রেলে চলাচলে নিরুৎসাহিত করতে এসব গল্প কেচ্ছা বড় অন্তরায় বলে মনে করেন রেল বিশেষজ্ঞরা। এদিকে প্রতিনিয়ত লোকসান দিতে দিতে রেলের লালবাতি জ্বলার উপক্রম। যদিও রেল একটি লাভজনক পরিবহন।
সারাদেশে ট্রেনযাত্রাও নিরাপদ নয়। কেন নিরাপদ নয় আর নিরাপত্তহীনতার কারণই বাকি এ বিষয়ে বেরিয়ে এসেছে ৭ কারণ। যেসব কারণে রেলকে নিরাপদ মনে করা হয় না। যার ভিতরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো অরক্ষিত লেভেলক্রসিং। সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কারণ যা আমদের চোখ রাঙাচ্ছে তা হচ্ছে জোড়াতালির গেটবার।
বাদ বাকি চার কারণের মধ্যে রয়েছে- পুরনো অবকাঠামো, রেলওয়ের সিগন্যাল অব্যবস্থাপনা, (যা ঠিকমতো কাজ না) রেলপথের ওপর অবৈধ রাস্তা, রেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনত ও পরিচালনাগত ত্রুটি। এসব কারণে ট্রেন দুর্ঘটনর পাশাপাশি রেল তার কাঙ্খিত যাত্রী পাচ্ছে না। যা অনেকটাই রেল যাত্রাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। সবমিলিয়ে নিরাপদে ট্রেনে চলাচলে নিশ্চিয়তা নেই।
পরিসংখ্যান বলছে, গত ছয় বছরে ১ হাজার ১১৬টি ট্রেন দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৩৪৫ জন নিহত এবং ১ হাজার ৩০২ জন আহত হয়েছেন। যার ভিতরে গত ২০২৪ সালের আগস্ট-নভেম্বর এই চার মাসে ঘটে ১৬০টি দুর্ঘটনা। নিহত হন ১৮ এবং আহত হন ২০০ যাত্রী। রেলের এ দুর্ঘটনার প্রায় ৮০ শতাংশই ঘটে থাকে চালক ও স্টেশন মাস্টারদের অবহেলা, লাইনচ্যুতি ও লেভেলক্রসিংয়ের কারণে। এরমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ লাইন ও দুর্বল সেতুর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে ৬৩ শতাংশ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেনের বলেন, দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ লেভেলক্রসিং। যে যেভাবে পারছে রেলপথ ধরে সড়ক নির্মাণ করছে। নেই কোনো গেট। রেলওয়ের আইনে এভাবে রেলপথের ওপর রাস্তা তৈরির কোনো সুযোগ নেই। বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে।
রেলের কিছু বড় দুর্ঘটনার বিবরণ: ২০২৫ সালের গত ৭ জানুয়ারি মধুমতি এক্সপ্রেস ট্রেন ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ট্রেনটি অনুমোদনবিহীন রেলক্রসিং অতিক্রম করার সময় মাইক্রোবাসটির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে নিহত হন ৫ জন এবং আহত হন বেশ কয়েকজন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে মৌলভীবাজারে এক রেল দুর্ঘটনার তদন্তে সিগন্যালের ত্রুটি এবং ম্যানুয়াল সিগন্যালের ভুলকে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এতে আহত হন একাধিক, নিহত ৫ জন।
আন্তঃনগর এগারোসিন্ধুর এক্সপ্রেস ও মালবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। মালবাহী ট্রেনটিসিগন্যাল অমান্য করে স্টেশনে প্রবেশ করায় দুর্ঘটনা ঘটে। এতে আহত হনএকাধিক, নিহত হন ২২ জন। রেল দুর্ঘটনায় সিগন্যালের ব্যর্থতা এবং ট্রেন অপারেটরদের মধ্যে যোগাযোগের অভাবকে দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এতে আহত হন শতাধিক।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম এক দুর্ঘটনায় রেলপথের অবকাঠামোত্রুটিপূর্ণ হওয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাব দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এতে আহত ৩০ এবং নিহত পাঁচজন। ২০২১ সালের জুনে নরসিংদী জেলায় এক দুর্ঘটনায় তদন্তে সঠিক সুরক্ষা প্রটোকল অনুসরণ না করাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আহত হয়েছিল ৪০ জনের অধিক এবং নিহত সাতজন।
টাঙ্গাইল জেলার ২০২০ সালের নভেম্বরে ত্রুটিপূর্ণ রেলপথের অবকাঠামো এবং আবহাওয়া জনিত সমস্যা রেল দুর্ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন একাধিক, নিহত হন ১০ জন। ২০১৮ মার্চে চাঁদপুরগামী মেঘনা এক্সপ্রেসে ওভারহিটিংয়ের ফলে আগুনধরে যায়। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পূর্বেই রেলওয়ে স্টাফরা আগুন নেভাতে সক্ষম হন।
২০১৮ সালের নভেম্বরে চাঁদপুরগামী মেঘনা এক্সপ্রেস ফেনী জেলার শর্শদী রেলগেটে একটি লোকাল বাসের সাথে সংঘর্ষ হয়। এই দুই ঘটনায় আহত হন ৪৫ জন, নিহতহন পাঁচজন। তার পরও ট্রেনে দুর্ঘটনার খবর থেমে নেই। যত্রতত্র লেভেলক্রসিং গড়ে তোলা এবং পুরাতন অবকাঠানোসহ সাতটি কারণে রেলপথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। এক্ষেত্রে দুর্ঘটনাপ্রবণ জেলা রয়েছে আটটি। এগুলো হচ্ছে মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর ও চাঁদপুর।
বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ‘রেলপথে অব্যবস্থাপনা ও যাত্রীহয়রানি’ সংক্রান্ত বিশেষ গোপন প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
সাত কারনে দুর্ঘটনা বাড়ছে : পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রতিবেদনে ট্রেন দুর্ঘটনার বিশেষ ৭টি কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অরক্ষিত লেভেলক্রসিং। এতে দেখা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে শত শত অবৈধ লেভেল ক্রসিংগড়ে উঠেছে। সারা দেশে বৈধ-অবৈধ মিলে প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি অরক্ষিত লেভেলক্রসিং রয়েছে।
বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, রেলপথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেলক্রসিং ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ। এর মধ্যে ৯৬১টি লেভেলক্রসিং সম্পূর্ণ অরক্ষিত। এসব ক্রসিংয়ে নেই কোনোগেটম্যান। রেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত এলজিইডি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের বিরুদ্ধে অবৈধ লেভেলক্রসিং তৈরি করার অভিযোগ রয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে জোড়াতালির গেটবার। লেভেলক্রসিংয়ের বেশির ভাগ গেটবারের অবস্থাও করুণ। জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা গেটবার নামানো হয় কোনো রকমে। এমনকি লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন এসে পৌঁছার আগাম সংকেত পাওয়ার ব্যবস্থাও নেই সব জায়গায়। লেভেল ক্রসিংয়ের আশপাশে গড়ে উঠেছে বস্তি, বাজারসহ নানা অবৈধ স্থাপনা। যার ফলে লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
তৃতীয়ত, রেল দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে পুরনো অবকাঠামো। কারণ বাংলাদেশে রেলপথের বেশিরভাগ অবকাঠামো পুরনো। অনেক রেলপথ এখনো মিটার গেজ। রেল লাইনের ত্রুটি, পুরনো স্লিপার, পুরনো ইঞ্জিন ও বগি এবং নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি গতিতে ট্রেন চালানো ট্রেন দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
চতুর্থত, রেলওয়ের সিগন্যাল ব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ না করায় বড় ধরনের ট্রেন দুর্ঘটনাগুলো ঘটে। কিছু সংখ্যক স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পয়েন্ট থাকলেও বেশির ভাগ সময় স্টেশন মাস্টার বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে পিএলসি সিস্টেমে তথ্য আদান-প্রদান করেন। এর ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।
পঞ্চমত, রেলপথের ওপর অবৈধ রাস্তা। রেলপথের ওপর অবৈধভাবে রাস্তা নির্মাণ করে থাকে সরকারের নানা সংস্থা। বিভিন্ন এলাকার অসচেতন জনগোষ্ঠী নিজেদের বাড়ির রাস্তা সোজা করতে রেললাইনের ওপর দিয়ে এখানে-সেখানে অবৈধভাবে অ্যাপ্রোচ সড়ক তৈরি করে। রেল লাইনের ওপরই প্রতিদিন পণ্য বেচাকেনা করতে জড়ো হন অসংখ্য মানুষ। পথচারী ও যান বাহনকে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং দ্রুত পেরুতে দিয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে।
ষষ্ঠ, রেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা। রেললাইন নিয়মিত পরিদর্শন করার নিয়ম থাকলেও তা যথাযথ ভাবে পালিত হচ্ছে না। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অফিস রুমে বসেই তাদের তদারকি সম্পন্ন করার নজির বিদ্যমান। রেলসেতু ভেঙে ট্রেন নিচে পড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে রেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করা হয়। রেল সেতুর আশপাশের রেললাইন থেকে রেল লাইনের ক্লিপ চুরি হয়ে যাওয়ায় ট্রেন লাইনচ্যুত হয় এবং কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অবগত থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত তদারকি না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটছে।
সপ্তমত, পরিচালনায় ত্রুটি। বেশকিছু দুর্ঘটনায় ট্রেন অপারেটরদের ভুল, সুরক্ষাপ্রটোকল অনুসরণ না করা বা অনুপযুক্ত প্রশিক্ষণের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। প্রতিবেদনে বলা হয়, রেলকে তুলনামূলক নিরাপদ বাহন হিসেবে গণ্য করা হয়। আর এ নিরাপত্তা নির্ভর করে মূলত রেলের বিন্যাস ব্যবস্থার ওপর। রেলকে জনআস্থায় আনতে হলে এসব সমস্যা দ্রুত চিহ্নিত করে তার আশু সমাধান নিশ্চিত করতে হবে।
