ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

যমুনা রেলসেতু: উত্তরবঙ্গে নবদিগন্তের সূচনা

রেল সেতুটি খুলে দেওয়ায় আমদানি-রপ্তানি খরচ কমার পাশাপাশি যমুনা সেতু ও মহাসড়কের ওপর চাপ কমবে। এর ফলে যমুনা সেতুর ঝুঁকিও হ্রাস পাবে।

আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৭:১০ পিএম

মো. আরশেদ আলী। বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। বসবাস করেন সিরাজগঞ্জ মূল শহরে। পেশায় হোটেল ব্যবসায়ী। সিরাজগঞ্জ চৌরাস্তার উত্তর পাশে তার হোটেল। আজ থেকে ২০ বছর আগে থেকে হোটেল ব্যবসা শুরু। আজকের আলোচিত স্থানটি সেদিন ছিল একবারেই অজ প্রত্যন্ত অঞ্চল। হাতে গোনা কিছু পরিবহনের ড্রাইভার, কন্ডাকটর, হেলপাররাই ছিলেন তার সারাদিন-রাতের কাস্টমার। 

বর্তমানে যমুনা সেতু, উড়াল সড়কসহ আধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত সড়কে গাড়ি চলায় সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের চিত্র বদলে গেছে। দিনের চেয়ে রাতের শহর অনেক মনোমুগ্ধকর। সেখানে আজ নতুন সংযোগ যমুনা রেলসেতু হয়ে ট্রেন চলাচল। যমুনা রেলসেতু চালু হওয়ায় পূরণ হচ্ছে আরেকটি স্বপ্ন। এভাবেই তিনি তার স্বপ্নপূরণের কথা জানালেন। 

মোহন রাজবংশি। তার বয়সও ৫৫’র কাছাকাছি। পেশায় মাছ ব্যবসায়ী। সিরাজগঞ্জ এলাকার যমুনা রেলসেতুর পশ্চিম পাশের স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি আনন্দ প্রকাশ করে বলেন, সাবেক ও বর্তমান সরকার সবই পারে। সাবেক সরকার পদ্মা সেতু করেছে, করেছে উড়াল সড়ক, ছয় লাইন ও ফোর লাইন সড়কও। আবার শুরু হয়েছে রেলপথ। এবার চলবে ট্রেন। এটা আমাদের জন্য গর্বের ও গৌরবের। বর্তমানে আমরা দ্রুত মাছ নিয়ে রাজধানীর বাজারে যেতে পারবো।
 
ফরিদপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গের ২৩ রেলপথের যোগাযোগের নব দিগন্তের সূচনা হলো। বিশেষ করে ক্ষুদ্র জেলেরা মাছ নিয়ে আসতে পারবে। তিনি আনন্দ প্রকাশ করে আরো বলেন, মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব  মো. ফাহিমুল ইসলাম যমুনা রেলসেতু উদ্বোধনের জন্য সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জে উপস্থিত হন।
 
এ উপলক্ষে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ আশপাশের অঞ্চল থেকে শত শত মানুষ উপস্থিত হন স্টেশনে। বিশেষ করে বিকেলে পর্যটন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যমুনা রেলসেতু দিয়ে চলবে ট্রেন। ‘যমুনা রেলসেতু’ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে যমুনার বুকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। একই সঙ্গে দু’অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো। 

উদ্বোধনীতে এসে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম এমন কথাতেই তিনি তার বক্তব্য শুরু এবং শেষ করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ  অতিথি ছিলেন জাপানি রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনিচি ও জাইকার সাউথ এশিয়া ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর জেনারেল ইতো তেরুকি। এর আগে বিষয়টি নিশ্চিত করেন যমুনা রেলসেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মাসুদুর রহমান।

মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদ রেলস্টেশনে রেলযোগাযোগের সবুজ পতাকা নেড়ে শুভ উদ্বোধন করেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম। যমুনা রেলসেতুতে রেল চলাচল উদ্বোধনের পর দুপুর ১১টা ৪০ মিনিটে টাঙ্গাইল ইব্রাহিমাবাদ রেল স্টেশনে উপস্থিত বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সামনে ব্রিফ করেন তিনি।
 
এ সময় তিনি বলেন, যোগাযোগের অন্যতম সাশ্রয়ী, সহজ, নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব মাধ্যম হচ্ছে রেল। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার মানের উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও আয় বৈষম্য নিরসনে ভারসাম্যমূলক সমৃদ্ধির মূলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বিরাট ভূমিকা পালন করে।  


এদিক থেকে এগিয়ে রয়েছে রেল যেটিকে বলা হয় সাশ্রয়ী যোগাযোগ মাধ্যম। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগের ফলে বদলে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা। পদ্মা সেতুর পর এবার যমুনায় রেলসেতু নির্মাণে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। দিন বদলের এই সুযোগে ঢাকা-রাজশাহী রুটে বাড়বে ট্রেন ও যাত্রীর সংখ্যা। 

তিনি জানান, রাজধানী ঢাকা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে যমুনা নদীর ওপর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেলসেতু। এ রেলসেতু চালু হওয়ায় ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ২৩ রেলপথের যোগাযোগে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। রেলওয়ে সেতু চালু হওয়ায় অপর প্রান্তের ট্রেনকে পারাপারের জন্য রেল থামিয়ে বসে থাকতে হবে না। এখন থেকে যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন রাজধানী থেকে সরাসরি চলে যাবে উত্তরবঙ্গে। 

যমুনা ইকো পার্কের পাশ দিয়ে যমুনা সেতুর পশ্চিম অংশের রেলপথের সঙ্গে সংযুক্ত। এ সেতুর পূর্ব পাশে ইব্রাহিমাবাদ এবং পশ্চিম পাশে সায়দাবাদ স্টেশন আধুনিকীকরণসহ ইয়ার্ড রিমডেলিং ও টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থার মডিফিকেশন, রেলওয়ে ব্রিজ মিউজিয়াম, সেতু রক্ষণাবেক্ষণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিস ও আবাসনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

রেল সেতুটি খুলে দেওয়ায় আমদানি-রপ্তানি খরচ কমার পাশাপাশি যমুনা সেতু ও মহাসড়কের ওপর চাপ কমবে। এর ফলে যমুনা সেতুর ঝুঁকিও হ্রাস পাবে। মানুষের সহজ যাতায়াত যেমন নিশ্চিত হয়েছে, তেমনি উত্তর জনপদের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গ থেকে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা সহজ হবে, কমবে পণ্য পরিবহন খরচ, যা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সামাজিক জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। 

আগের সড়কসেতু দিয়ে আর রেল চলছে না। ফলে ট্রেনে যমুনা নদী পাড়ি দিতে সময় লাগছে তিন থেকে পাঁচ মিনিট। আগে সময় লাগত ২০ থেকে ২৫ মিনিট। তবে দ্রুত নদী পাড়ি দিতে উত্তরের রেলযাত্রীদের বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে। নতুন সেতু ব্যবহার করে চলা ট্রেনের আসন ভেদে ভাড়া বাড়ছে ৪৫ থেকে ১৬০ টাকা পর্যন্ত। বুধবার (১৯ মার্চ) থেকে এ বাড়তি ভাড়া কার্যকর হবে। 

ভাড়া বৃদ্ধি প্রসঙ্গে রেল সূত্র জানায়, যমুনা রেল সেতুটির দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৮কিলোমিটার। কিন্তু সেতুটিকে ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে। অর্থাৎ সেতুটির প্রতি কিলোমিটার দূরত্বকে ২৫ কিলোমিটারে বাড়িয়ে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। অবশ্য যমুনা সড়ক  সেতু দিয়ে ট্রেন চলার সময়ও প্রতি কিলোমিটারকে ১৭ কিলোমিটার ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল। নতুন সেতুতে প্রতি কিলোমিটারে আট কিলোমিটার বেড়েছে।


নতুন সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হিসেবে বাড়তি ভাড়া আদায়ের রেওয়াজ ব্রিটিশআমল থেকে চালু আছে। এতদিন কত বাড়তি আদায় হবে, এর সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম ছিল না। পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চালুর সময় সেতুর বাড়তি ভাড়া হিসাবের ক্ষেত্রে নতুন করে চালু বড় সেতুর প্রতি কিলোমিটারকে ২৫ কিলোমিটার ধরে ভাড়া নির্ধারণের নিয়ম চালু হয়েছে। 

পাকশী বিভাগীয় বাণিজ্যিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে রেলে কিলোমিটার প্রতি এসি শ্রেণির ভিত্তি ভাড়া ১ টাকা ৯৫ পয়সা। নন-এসি শ্রেণির ভিত্তি ভাড়া ১ টাকা ১৭ পয়সা। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত হয়। এছাড়া আন্তঃনগর ট্রেনে বিরতিহীন চার্জ যুক্ত হয় আরো ১০ শতাংশ। দেশে লোকাল, মেইল,কমিউটার ও আন্তঃনগর এই চার ধরনের ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে ভাড়ার হার কিছুটা কমবেশি আছে। আন্তঃনগর ট্রেনেও বিভিন্ন শোভন চেয়ার, এসি চেয়ার, এসি সিট ও এসি বার্থ (শুয়ে যাওয়ার আসন) শ্রেণি রয়েছে। প্রতিটি আসনের ভাড়া নির্ধারণে এসব হিসাব আমলে নেওয়া হয়।

জানা গেছে,  ট্রেনযাত্রায় সবচেয়ে সময় কমেছে একতা এক্সপ্রেস (৭০৬ ডাউন) ট্রেনের। এ ট্রেন পঞ্চগড় স্টেশন থেকে রাত ৯টা ১০ মিনিটে ছেড়ে ঢাকা কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছাবে সকাল ৭টা ২০ মিনিটে। এ ট্রেন আগে ৭টা ৫০ মিনিটে ঢাকা পৌঁছাত। নতুন সময়সূচি অনুযায়ী এ ট্রেন ৩০ মিনিট কম সময়ে গন্তব্য পৌঁছাবে। 

যেসব ট্রেন চলাচল করছে 
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের একতা এক্সপ্রেস, চিত্রা এক্সপ্রেস, বনলতা এক্সপ্রেস, ঈশ্বরদী থেকে ঢাকাগামী ঢাকা কমিউটার, সিল্কসিটি এক্সপ্রেস, ধূমকেতু এক্সপ্রেস, লালমনি এক্সপ্রেস, পদ্মা এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস, চিলাহাটি এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, বুড়িমারী এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস, নীলসাগর এক্সপ্রেস ও সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস নতুন ব্রিজ ব্যবহার করে চলাচল করছে।

Fj
আরও পড়ুন