ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

সান্ডা থেকে গাধা

প্রাণীর প্রতি তামাশার সংস্কৃতি এখন নির্লজ্জ ট্রেন্ড!

আপডেট : ২৪ মে ২০২৫, ১০:১৮ এএম

কৌতুকের জগতে প্রাণীরাও যে হঠাৎ করেই পরিণত হয় বিদ্রূপের পাত্রে, তার এক বেদনাদায়ক প্রমাণ হয়ে উঠেছে ‘সান্ডা’। সিলেট থেকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে নিরীহ এই প্রাণীটিকে কোলে নিয়ে থাকা একজন মানুষের দৃশ্য দেখে শুরু হয় ট্রলের তাণ্ডব। ভিন্ন গঠন ও স্বভাবকে পুঁজি করে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য বিকৃত মিম, যৌন রসিকতা ও কুরুচিপূর্ণ ভিডিও।

সান্ডা বা প্যাঙ্গোলিন এক প্রকার নিশাচর স্তন্যপায়ী প্রাণী, যার শরীর ঢেকে থাকে শক্ত আঁশে- যা তৈরি কেরাটিন দিয়ে, যেমন মানুষের নখ বা চুল। সে ভয় পেলে নিজেকে বলের মতো গুটিয়ে ফেলে। অথচ এই স্বাভাবিক আচরণই হয়ে উঠেছে ট্রলের খোরাক।

এই নিরীহ ও আত্মরক্ষামূলক স্বভাবের প্রাণীটি যখন সামাজিক ট্রলের শিকার হয়, তখন তা শুধু একটি প্রাণীর অপমান নয়, বরং আমাদের সংবেদনশীলতারও পরাজয়। এমন একটি শান্তিপ্রিয় প্রাণীকেও যদি আমরা কৌতুকের খোরাক বানাই, তবে প্রশ্ন জাগে- আমাদের রসবোধ কতটা বিকৃত হয়ে গেছে?

এই ট্রলের নেপথ্যে আছে বিকৃত মানসিকতা। ইন্টারনেটকে ‘নির্দ্বিধা আনন্দের মাঠ’ ভাবা এক শ্রেণির মানুষ মনে করে- তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। এই প্রবণতা আসলে নিঃসঙ্গতা, রসবোধের অবক্ষয় এবং সহানুভূতির ঘাটতির বহিঃপ্রকাশ।

আমরা কি এতটাই নীচে নেমে গেছি যে, একটি নিরীহ প্রাণীকেও বিকৃত রসিকতার পাত্র করে তুলছি? এক প্রাণীর অস্বাভাবিক গঠন বা আচরণ কি শুধুই হাস্যরসের জন্য ব্যবহারযোগ্য?

সান্ডা আজ শুধুই একটি প্রাণীর নাম নয়। সে আমাদের বিবেকের আয়নায় এক কদর্য চেহারা দেখায়- যেখানে বিকৃত রসবোধ, যৌন সংকেতের অতিরঞ্জন এবং সামাজিক অবক্ষয়ের ছাপ স্পষ্ট।

প্রাণীদের নিয়ে কৌতুক থামানো যাবে না, কিন্তু তার রুচি, মাত্রা ও উদ্দেশ্য বিবেচনা করা জরুরি। কারণ আমরা কাকে হাস্যকর বানাচ্ছি, আর কেন তা করছি- সে প্রশ্নেই লুকিয়ে আছে আমাদের সমাজের মানবিকতা।

তবে শুধুমাত্র সান্ডা নয়- মানুষের বিদ্রূপের শিকার হয়েছে আরও অনেক প্রাণী। প্রাণীর প্রতি এই তামাশার সংস্কৃতি যেন এখন এক নির্লজ্জ ট্রেন্ড।

ল্যামা : লাতিন আমেরিকার এই প্রাণীটি মেমে সংস্কৃতিতে ‘স্টুপিড বাট কিউট’ হিসেবে পরিচিত। হাঁটার ধরন আর মুখভঙ্গি তাকে করেছে বিদ্রূপের প্রতীক। থুতু ফেলার প্রবণতা তাকে বানিয়েছে ‘রুড অ্যানিমেল’।

02

শ্লথ : অতিমাত্রায় ধীর গতির জন্য সে ‘লেইজি লাইফ গোলস’ কিংবা ‘মানডে মুড’ নামক মিমের বিষয়বস্তু। অথচ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এই ধীরতাই অপরিহার্য।

03

গাধা : ইতিহাসজুড়ে গাধা ছিল কৌতুক ও অবজ্ঞার প্রতীক। সাহিত্যে, কথ্য ভাষায়, এমনকি রূপকথাতেও গাধাকে উপস্থাপন করা হয় ‘মূর্খ’ হিসেবে। অথচ বাস্তবে সে পরিশ্রমী ও সহিষ্ণু।

04

উট : মুখভঙ্গির কারণে সামাজিক মাধ্যমে অনেক সময় উটকে বলা হয় ‘গ্রাম্পি ওল্ড ম্যান’। অথচ চরম প্রতিকূল মরুভূমিতে বেঁচে থাকার প্রতীক এই প্রাণী।

05

কুকুর ও বিড়াল : মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়েও তারা সামাজিক মাধ্যমে পরিণত হয়েছে হাস্যকর ভিডিওর কেন্দ্রবিন্দুতে। তাদের স্বাভাবিক আচরণগুলো নিয়ে তৈরি হয় বিকৃত কনটেন্ট।

Untitled

সান্ডা থেকে গাধা- সব প্রাণীই আমাদের মতোই এই পৃথিবীর বাসিন্দা। আজ আমরা যদি তাদের নিয়ে কৌতুকের নামে কুরুচির সীমানা ছাড়িয়ে যাই, তবে কাল আমরা নিজেদেরই ছোট করব।

একটি প্রশ্ন তাই থেকে যায়- আমরা কি এখনো সভ্য সমাজে বাস করছি, নাকি তামাশার এক নির্মম যুগে?

RF
আরও পড়ুন