‘আমার মেয়ে কোনো অপরাধ করেনি। কিন্তু কিছু লোক প্রকাশ্যে তাকে হেনস্তা করে’, কথাগুলো বলছিলেন ভারতের উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর এলাকার এক নারী। তার মেয়েকে কয়েকদিন আগে রাস্তায় হেনস্তা করা হয় এবং সেই ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়, মুজফফরনগরের রাস্তায় প্রকাশ্যে এক নারীর বোরকা খুলে নিতে এবং তাকে অপদস্থ করতে। তার (ওই নারীর) সঙ্গে যে ব্যক্তি ছিলেন, তাকেও হেনস্তা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সঙ্গে থাকা ব্যক্তির নাম শচীন। তিনি ব্যাংকের একজন কর্মী।
যে নারীর সঙ্গে এই ঘটনা ঘটে তার মা বলেছেন, এই ঘটনায় আমি নিজেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। সংসারের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় আমাদের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হয়। মেয়ে অন্য সম্প্রদায়ের একজনের সঙ্গে কাজে গিয়েছিল, সে কারণে সন্দেহবশত তার বোরকা খুলে নেওয়া হয় এবং মারধর করা হয়। তারা ভুল সন্দেহ করে আমার মেয়েকে মারধর করেছে এবং আমার সহকর্মীর সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করেছে। আমি তাদের কখনোই ক্ষমা করব না। আমার মেয়ের মানসিক অবস্থা এখন ভালো নয়, সে কথা বলতে পারবে না। তবে আমরা দোষীদের শাস্তি চাই।
এই ঘটনাটি ঘটেছে গত ১২ই এপ্রিল। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে স্থানীয় পুলিশ। ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখে বাকিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ছয়জন গ্রেপ্তার
ঘটনার দিন অর্থাৎ, ১২ এপ্রিলের ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পরে, হেনস্তার শিকার ওই নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পুলিশ।

ভাইরাল হওয়া এই ভিডিওর ফুটেজের ওপর ভিত্তি করে সরতাজ, শাদাব, মহম্মদ উমর, আর্শ, শোয়েব ও শামি নামে ছয়জন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নিগ্রহের শিকার ওই নারীর পরিবার যে এলাকায় বসবাস করেন, গ্রেপ্তারকৃতরাও একই এলাকার।
ডিএসপি রাজু কুমার জানিয়েছেন, ভিডিও দেখে বাকি অভিযুক্তদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে এবং তাদেরও শিগগিরই গ্রেপ্তার করা হবে।
ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১১৫ (২), ৩৫২, ১৯১ (২) এবং ৭৪ নম্বর ধারায় মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। এই ধারাগুলোয় মারধর, গালিগালাজ করা, দাঙ্গা ও শ্লীলতাহানি সম্পর্কিত অপরাধ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আতঙ্কে রয়েছে পরিবার
ঘটনার পর থেকে ওই নারী এবং তার পরিবার আতঙ্কে রয়েছে জানিয়ে ওই নারীর মা জানান, তার মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছেন। কারও সঙ্গে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই তিনি।
তিনি বলেন, আমার মেয়ের সঙ্গে কী কী হয়েছে, আপনারা নিশ্চয়ই তা ভিডিওতে দেখেছেন। ও আর কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। এখনও বিয়ে হয়নি আমার মেয়ের। ঘটনার পর থেকে খুবই আতঙ্কে রয়েছে সে। আমার ছয় সন্তান। তাদের মধ্যে পাঁচজন মেয়ে ও এক ছেলে। আমার স্বামী আট বছর আগে মারা গেছেন। তাই সংসারের সব খরচ আমাদেরই চালাতে হয়। গত কয়েক মাস ধরে তার সঙ্গে ব্যাংকে কাজ করছেন শচীন নামে ওই ব্যক্তি। ওইদিন তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কাজে যান শচীন। তারপরই এই ঘটনা ঘটে।
অভিযুক্তদের পরিবার কী বলছে?
এই ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তদের পরিবারের সদস্যরা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন আর্শ নামে স্থানীয় বাসিন্দা। তার মা বলেছেন, মেয়েটির সঙ্গে যা ঘটেছে তা অন্যায়, কিন্তু এতে আমার ছেলের কোনো দোষ নেই। ও গিয়ে ঘটনাস্থলে শুধু দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে লেখাপড়া করছে আমার ছেলে। ওর জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা ন্যায়বিচার চাই।
এই ঘটনায় পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করেছে, তাদের বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ঘটনাটি যে দোকানের সামনে ঘটেছিল সেই দোকানের মালিক নওশাদ জানিয়েছেন, তার দুই কর্মচারীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তার দোকানে কর্মরত দুইজন হেনস্থার শিকার ওই নারীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিছু লোক জোর করে আমার দোকানে ঢুকে ভিক্টিমকে (হেনস্থার শিকার নারীকে) মারধর করছিল। আমার কর্মচারীরা তাদের বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানকার কাউন্সিলর নওশাদ পাহলওয়ান বলেন, মা-মেয়ে একটি স্মল ফিন্যান্স কোম্পানির ঋণ সংক্রান্ত বিষয়ে কাজের জন্য এই এলাকায় আসতেন। একজন ব্যাংক কর্মীর সঙ্গে মেয়েটিকে দেখে ভুল বোঝাবুঝির ফলে তাকে (মেয়েটিকে) মারধর করা হয়। শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অভিযুক্তরা তাদের মারধর করে বলে জানান তিনি।
তার কথায়, বর্তমানে ঋণ দেওয়ার একটি প্রকল্প চলছে, সেখানে ওই মা-মেয়ে কাজ করেন। ওরা যে কাজে যাচ্ছে, সেটা কেউ ভাবেনি। শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে ওই ছেলে ও মেয়েটিকে দাঁড় করিয়ে মারধর করা হয়েছে। এটি অন্যায়।
আমরা শচীনের সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনি ঘটনার দিন হেনস্থার শিকার ওই নারীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি তিনি। শুধু বলেছেন, প্রশাসনের পদক্ষেপ ন্যায়সঙ্গত। ভিডিওতে যা দেখা যাচ্ছে তাই ঘটেছে।
এই ঘটনার বিষয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিলেছে। স্থানীয় এক দোকানদার জানিয়েছেন, ঘটনাটি তাড়াহুড়োর মধ্যে ঘটেছিল। তার কথায়, মেয়েটির সঙ্গে যা ঘটেছে, তা অন্যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা মুশাহিদ আলম খান এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে পুলিশ ও প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপের প্রশংসা করেন।
ওই এলাকার আরেক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, আমাদের শহর শান্ত, এমন আকস্মিক ঘটনায় আমরাও দুঃখিত। কিন্তু যারা এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই বয়স কম। সূত্র: বিবিসি বাংলা
