পুরোনো দুই শত্রু—ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে মাত্র কয়েক দিন আগে ঘটে যাওয়া পাল্টাপাল্টি হামলা নিয়ে নীতিনির্ধারক, বিশ্লেষক ও সামরিক নেতাদের মনোযোগ এখনও সেদিকে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে খবরের শিরোনাম দ্রুত বদলায়।
এবারের হামলার ঘটনায় ইরান ও ইসরায়েল যে খাদের কতটা কিনারে চলে গিয়েছিল, তা আসলেই গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করার মতো। কারণ, এই প্রথম দুই দেশ সরাসরি একে অপরের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়েছে।
বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে সম্মিলিতভাবে ইরানের চালানো সবচেয়ে বড় হামলা ছিল এটি। এমনকি রাশিয়াও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে একসঙ্গে এত সমরাস্ত্র ব্যবহার করেনি। আর ১৯৯১ সালে সাদ্দাম হোসেন ইসরায়েল লক্ষ্য করে স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর এটি ছিল দেশটিতে বহিঃশত্রুর সবচেয়ে বড় হামলা।
১৩ এপ্রিল রাতে ইসরায়েলে তিন শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করে ইরান। সেগুলোর বেশির ভাগই রুখে দেওয়ার দাবি করেছে ইসরায়েল। তবে জেরুজালেমে আমার অফিস থেকে দেখেছি, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলো ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোর সময় আকাশ কীভাবে আলোকিত হয়ে উঠেছিল।
কোনোভাবে ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর একটি শহরের মধ্যে পড়লে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতো। যেমন পশ্চিমা এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা আমাকে বলছিলেন, ‘ওই সময়ে আমরা (ধ্বংসযজ্ঞের) কতটা কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম, তা ইসরায়েলের মানুষ বুঝতে পারেনি। সেদিনের গল্পটা অনেক আলাদা হতে পারত।’
প্রথমে গোয়েন্দা সফলতার বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যাক। আমাকে বলা হয়েছিল, রোববার ভোররাতের ওই হামলার আগে বুধবার সকালে ইরানের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, পরিকল্পনা জানতে পারার কারণেই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষায় উপসাগরীয় অঞ্চলের কয়েকটি দেশকে এগিয়ে আসতে রাজি করাতে পেরেছিল মার্কিন সরকার।
১৩ এপ্রিল রাতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসা উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে ছিল সৌদি আরব ও জর্ডান। তবে সেদিন তাদের ভূমিকা কী ছিল, তা এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। জর্ডান এটা স্বীকার করেছে, নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ইরানের ড্রোন ধ্বংস করেছে তারা। এটাও বোঝা গেছে যে নিজেদের আকাশসীমায় ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে তারা।
আর সৌদি আরবের ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, দেশটি যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের হামলার বিষয়ে তথ্য দিয়েছিল। পাশাপাশি ইয়েমেন থেকে ইরানপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হুমকির দিকে নজর রেখেছিল। মোদ্দাকথা হলো, সম্মিলিত এ প্রচেষ্টা কাজে লেগেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জর্ডান ও সৌদি আরবের সামরিক বাহিনী এটা দেখিয়েছে, আকাশ প্রতিরক্ষায় তারা সম্মিলিতভাবে কাজ করতে পারে।
লন্ডনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক এমিল হোকাইয়েমের মতে, ইরানের হামলা এটা দেখিয়েছে যে নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য ইসরায়েল মিত্রদের ওপর কতটা নির্ভরশীল। তাঁর আরেকটি প্রশ্ন হলো, আরও তীব্র সংঘাতের সময় প্রয়োজনীয় যথেষ্ট পরিমাণ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের হাতে আছে কি নেই?
ইরান–ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্য দিয়ে নতুন আঞ্চলিক সামরিক জোটের সূচনা হয়েছে, এমন ধারণাও উড়িয়ে দিয়েছেন এমিল হোকাইয়েম। তিনি বলেন, আরব দেশগুলো সহযোগিতা করেছে। কারণ, তারা আঞ্চলিক কোনো সংঘাত চায়নি। তারা এটাও দেখাতে চেয়েছে যে তারা পশ্চিমা মিত্রদের ভালো সহযোগী। আর এটা আরব দেশগুলোর নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়ও।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার বলছে, ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সক্ষমতা ও দুর্বলতাগুলো ইরানকে বুঝতে সহায়তা করেছে এ হামলা। আর ইরানের কৌশল সম্পর্কে বড় ধারণা পেয়েছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র।
ইরান ও ইসরায়েল নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার একটি শিক্ষা পেয়েছে—এমন ধারণা মানতে নারাজ গবেষক এমিল হোকাইয়েম। তাঁর মতে, সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালিয়ে ইরানি রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যার ফল কী হতে পারে, তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল ইসরায়েল। তিনি বলেন, এই দুই দেশ একে অপরের সঙ্গে কথা বলে না। এর বিপরীতে তারা সামরিক তৎপরতা ও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ইঙ্গিত দেয়। বিষয়টি দ্রুতই খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
