ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার (সোমপুর বিহার)। পাল আমলের ৭৭ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত এই বিশাল স্থাপত্যশৈলী দেখতে প্রতিবছর দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসেন ৫ থেকে ৭ লাখ দর্শনার্থী। তবে পর্যটকদের পদচারণায় মুখর এই ঐতিহাসিক স্থানটি বর্তমানে নানামুখী সংকটে জর্জরিত। জলাবদ্ধতা, আবাসন সংকট, নিম্নমানের খাবার এবং কুকুরের উপদ্রবে এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের পোহাতে হচ্ছে চরম ভোগান্তি।
ঐতিহাসিকদের মতে, পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার নির্মাণ করেন। ১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন এবং ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। আয়তনে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের সঙ্গে তুলনীয় এই বিহারটি ছিল ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের বিখ্যাত ধর্মচর্চা কেন্দ্র। একসময় চীন, তিব্বত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ভিক্ষুরা এখানে জ্ঞান অর্জনের জন্য আসতেন। দশম শতকে এখানকার আচার্য ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বর্ষা মৌসুম শেষ হলেও বিহার চত্বরে জমে থাকা পানি স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে। এতে ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি যেমন ঝুঁকির মুখে পড়ছে, তেমনি পর্যটকরাও মূল বিহারের কাছে যেতে পারছেন না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কুকুরের উপদ্রব। বিহার চত্বরে খাবারের প্যাকেট হাতে নিলেই কুকুরের পাল পর্যটকদের ঘিরে ধরছে, যা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে।

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিথিলা বলেন, ‘এটি আমাদের ঐতিহাসিক সম্পদ। কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে কাছ থেকে বিহারটি দেখা সম্ভব হয়নি। এভাবে পানি জমে থাকলে স্থাপনাটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়া এখানে খেতে বসে কুকুরের উপদ্রবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়েছে।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী ও পর্যটক মোহাম্মদ আশিক বলেন, ‘এখানে খাবারের দোকানগুলোতে অতিরিক্ত দাম নেওয়া হচ্ছে। ২৫ টাকার খাবার ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভেতরে ভালো কোনো ক্যাফেটেরিয়া নেই, বাইরেও মানসম্মত রেস্তোরাঁ বা আবাসিক হোটেল নেই। দূর থেকে আসা পর্যটকদের জন্য সরকারিভাবে আবাসনের ব্যবস্থা করা হলে পর্যটক সংখ্যা আরও বাড়বে।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিক আশরাফ বলেন, ‘সোমপুর বিহার একসময় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ছিল, যা এখন কেবল পিকনিক স্পটে পরিণত হয়েছে। এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য পর্যটকদের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। এছাড়া স্থানীয়দের মধ্যে পর্যটকবান্ধব মানসিকতার অভাব রয়েছে। রিকশা ভাড়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পর্যটকদের সঙ্গে তারা যে আচরণ করছে, তা সম্মানহানিকর।’

সার্বিক বিষয়ে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু বলেন, ‘বাংলাদেশে যে দুটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট রয়েছে, তার মধ্যে পাহাড়পুর অন্যতম। প্রতিবছর এখানে ৫-৭ লাখ পর্যটক আসেন, যার মধ্যে বিদেশি পর্যটক থাকেন প্রায় ৫-৭ হাজার। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মূল কাজ হেরিটেজ রক্ষা করা, তবে গবেষকদের জন্য সীমিত পরিসরে রেস্ট হাউসের ব্যবস্থা রয়েছে। পর্যটকদের আবাসনের বিষয়টি পর্যটন কর্পোরেশনকে জানানো হয়েছে।’
জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিহারটি নিচু এলাকায় হওয়ায় বর্ষায় পানি জমে। পাম্পের মাধ্যমে পানি সরানোর চেষ্টা করা হয়, তবে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে তা কঠিন হয়ে পড়ে। পানি নিষ্কাশনের স্থায়ী সমাধানের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে আলোচনা চলছে।’
সুন্দরবনে নতুন পর্যটন স্পট ‘আলীবান্দা’
পর্যটন দিবসে কুয়াকাটায় হতাশ ভ্রমণপিপাসুরা