ইউরোপের দেশগুলিকে কড়া বার্তা দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, ভারতের প্রয়োজন অংশীদার, উপদেশদাতা নয়। রোববার (৪ মে) ভারতের থিংকট্যাঙ্ক সংস্থা আর্কটিক সার্কেল ইন্ডিয়া ফোরামের সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জয়শঙ্কর। সেখানে নিজ বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। খবর: আরটি
নিজ মন্তব্যে ইউরোপীয় দেশগুলোর দুর্বলতা নিয়েও মন্তব্য করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হতে হলে কৌশলগত স্বায়ত্বশাসন জরুরি; কিন্তু ইউরোপের জন্য এটি অর্জন করা কঠিন। কারণ, ইউরোপ নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, জ্বালানির জন্য রাশিয়া ও বাণিজ্যের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল। বৈশ্বিক রাজনীতিতে এ ধরনের নির্ভরশীলতা ঝুঁকিপূর্ণ কারণ, কারণ এখানে যে কোনো সময় পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে।
জয়শঙ্করের মতে, ইউরোপকে এখন বাস্তবে ফিরে আসতে হবে। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে তাদেরও কিছু সংবেদনশীলতা দেখানো প্রয়োজন। শুধুই পরামর্শ দিলে হবে না। আদর্শগত মতাপর্থক্য সরিয়ে পারস্পরিক সাহায্যের মাধ্যমেই আমেরিকার সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখা যাবে বলেও জানান ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমরা যখন বিশ্বের দিকে তাকাই, তখন আসলে আমরা অংশীদার খুঁজি, উপদেশদাতা নয়। বিশেষ করে সেইসব উপদেশদাতাদের একেবারেই নয়-যারা অন্যদের যেসব উপদেশ দেয়-সেসব নিজেরা পালন করে না।’
সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফে বার্তা দেওয়া হয়েছিল, সংঘাত মেটাতে ভারত ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক পথে সমাধানের পথ খোঁজা উচিত। সেই বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই জয়শঙ্করের এদিনের বক্তব্য বলে মনে করা হচ্ছে।
জয়শঙ্কর ভারতের রাশিয়া বাস্তববাদের প্রতি ধারাবাহিক সমর্থনের কথা উল্লেখ করে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে গভীর সামঞ্জস্য ও পরিপূরকতার দিকটি তুলে ধরেন, যেখানে একপক্ষ সম্পদের জোগানদার এবং অন্যপক্ষ ভোক্তা হিসেবে কাজ করছে। তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব সমাধানে রাশিয়ার অংশগ্রহণ ছাড়াই পশ্চিমি বিশ্বের পূর্ববর্তী প্রচেষ্টারও সমালোচনা করেন। যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের পদ্ধতি বাস্তববাদের মৌলিক নীতিকেই চ্যালেঞ্জ করেছিল।’
জয়শঙ্কর বলেন, ‘যেভাবে আমি রাশিয়ান বাস্তববাদের পক্ষে, সেভাবেই আমেরিকান বাস্তববাদেরও পক্ষপাতী। বর্তমান সময়ে আমেরিকার সঙ্গে যোগাযোগের সর্বোত্তম উপায় হল মতাদর্শগত পার্থক্যকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং সাধারণ স্বার্থের মিল খুঁজে বের করা, যা একসঙ্গে কাজ করার সম্ভাবনাকে ম্লান হতে দেয় না।’
জয়শঙ্কর ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘সম্পদ প্রদানকারী ও ভোক্তা হিসেবে দু'দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামঞ্জস্য ও পরিপূরকতা রয়েছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে, আমরা সবসময়ই রাশিয়া বাস্তববাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি (Europe)। ২০২২-২০২৩ সালের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী ও পরিস্থিতি কল্পনা করা হয়েছিল, যা সময়ের পরীক্ষায় সঠিক বলে প্রমাণিত হয়নি।’
এদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংঘাত মেটাতে আলোচনার ওপরই জোর দিয়েছে রাশিয়া। পেহেলগামে হামলার বিষয়ে গত শুক্রবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন জয়শঙ্কর। তিনি লাভরভকে জানান, পেহেলগামে হামলায় ষড়যন্ত্রকারী, সাহায্যকারী, সাহায্যকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতেই হবে। লাভরভ তাকে অনুরোধ করেন, যুদ্ধের বদলে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পথেই ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে সংঘাত মিটিয়ে নিক। এই প্রসঙ্গে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে শিমলা চুক্তি ও লাহোর ঘোষণার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে রাশিয়া। মস্কোর সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক নিয়েও লাভরভ ও জয়শঙ্করের মধ্যে আলোচনা হয়।
ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলাকে ঘিরে প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে যে উত্তেজনা শুরু হয়েছে ভারতের, সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভারতের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
গত ২২ এপ্রিল মঙ্গলবার বিকেলে ভারতের জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের পেহেলগাঁও জেলার বৈসরণ তৃণভূমিতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে হামলাকারীরা অন্তত ২৬ পর্যটককে গুলি করে হত্যা করে, আহত হন আরও বেশ কয়েকজন। নিহতরা সবাই পুরুষ।
ভয়াবহ এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত এবং তাৎক্ষণিকভাবে দেশটির সিন্ধু নদের পানিবন্টন চুক্তি স্থগিতসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। পাল্টা জবাব হিসেবে ভারতের জন্য নিজেদের স্থল ও আকাশসীমা বন্ধসহ একাধিক পদক্ষেপ নেয় পাকিস্তানও।
এ হামলাকে ঘিরে তীব্র উত্তেজনা শুরু হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দুই চিরবৈরী প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে।
