মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াবের আশায় কাউকে কোনো ধরনের লাভ ছাড়া নিঃশর্ত ঋণ দেওয়াকে কর্জে হাসানা বলে। অভাবগ্রস্ত লোকদের অর্থ ধার দিয়ে তাদের সমস্যা থেকে মুক্তি দেওয়া এবং মানুষকে কষ্ট ও দুর্দশার সময়ে সাহায্য করা ইসলামের দৃষ্টিতে একটি মহান ফজিলতপূর্ণ কাজ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন সময় তাঁর প্রিয় সাহাবিদের কর্জে হাসানার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তেমনি যথাসময়ে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারেও কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন।
কর্জে হাসানার ফজিলত
কাউকে কোনো ধরনের বিনিময় ছাড়া নিঃশর্ত ঋণ দেওয়া মূলত আল্লাহকে ঋণ দেওয়ার শামিল। অর্থাৎ যে ব্যক্তি প্রফুল্লভাবে এবং মুখে হাসি নিয়ে মানুষকে অর্থ ধার দেয় এবং ধার দেওয়ার পর গ্রহীতার প্রতি অনুগ্রহ করে, ক্ষতি করে না ও কষ্ট দেয় না এবং ঋণ পরিশোধের জন্য বিনা কারণে হয়রানি করে না, প্রকৃতপক্ষে সে যেন আল্লাহকে ঋণ দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বহুগুণ বৃদ্ধি করে এর প্রতিদান দেবেন।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘এমন কে আছে যে আল্লাহকে কর্জ দেবে উত্তম কর্জ? অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন’ (সুরা বাকারা : ২৪৫)।
এ আয়াতে আল্লাহকে ঋণ দেওয়ার অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। তন্মধ্যে এক অর্থ হলো, তাঁর বান্দাদের ঋণ দেওয়া এবং তাদের অভাব দূর করা।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কোনো বিপদ-আপদ দূর করে দেবে, আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিনে তার থেকে বিপদ দূরীভূত করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্ত লোকের জন্য সহজ ব্যবস্থা (দুর্দশা লাঘব) করবে, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দুর্দশা মোচন করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের ত্রুটি গোপন রাখবে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তার ত্রুটি গোপন রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে, আল্লাহ ততক্ষণ তার সাহায্যে নিয়োজিত থাকেন’ (মুসলিম : ৬৬০৮)।
ঋণ সদকার সওয়াব
বিভিন্ন হাদিসে নিঃশর্ত ঋণ দেওয়াকে সদকা বলে গণ্য করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক ঋণই সদকাস্বরূপ’ (বায়হাকি, শুআবুল ঈমান : ৩২৮৫)।
আরও বলেছেন, ‘যে মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে দুইবার কর্জ দেয়, সে ওই পরিমাণ সম্পদ একবার সদকা করে দেওয়ার সওয়াব পায়’ (ইবনে মাজা : ২৪৩০)। সাধারণত কোনো নেক আমলের সওয়াব আল্লাহ তায়ালা কমপক্ষে দশগুণ দিয়ে থাকেন। কিন্তু কর্জে হাসানার সওয়াব এর চেয়েও বেশি দিয়ে থাকেন।
হজরত আনাস ইবন মালিক (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মিরাজের রাতে আমি জান্নাতের একটি দরজার ওপর লেখা দেখলাম, সদকায় ১০ গুণ সওয়াব এবং কর্জে (ঋণে) ১৮ গুণ। আমি বললাম, হে জিবরাঈল! কর্জ সদকার চেয়ে উত্তম কেন? তিনি বললেন, কারণ ভিক্ষুক তার কাছে (সম্পদ) থাকতেও চায়। আর কর্জদার প্রয়োজন ছাড়া কর্জ চায় না’ (ইবনে মাজা : ২৪৩১)।
ঋণ পরিশোধে সময় দেওয়া
ঋণ নেওয়ার পর কিছু মানুষ পরিশোধের ক্ষেত্রে উদাসীন হয়ে যায়। তাদের ক্ষেত্রে কঠোর হওয়ার যেমন বৈধতা রয়েছে; তেমনি যারা অসচ্ছলতার দরুন ঋণ পরিশোধে সক্ষম হচ্ছে না তাদেরকে সময় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘এবং কোনো (দেনাদার) ব্যক্তি যদি অসচ্ছল হয়, তবে সচ্ছলতা লাভ পর্যন্ত (তাকে) অবকাশ দেওয়া উচিত। আর যদি সদকা করে দাও, তবে তোমাদের পক্ষে সেটা অধিকতর শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি করো’ (সুরা বাকারা : ২৮০)।
হাদিস শরিফে এসেছে, অসচ্ছল ব্যক্তিদের ঋণ পরিশোধে যতদিন সময় দেবে সে ততদিন সদকার সওয়াব পেতে থাকবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে গরিবকে (তার ঋণ আদায়ে) সময় দেবে, সে প্রতিদিন সদকা দেওয়ার মতো সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি তার মেয়াদ চলে যাওয়ার পরও তাকে সময় দেবে, সে প্রতিদিন সেই ঋণের সমপরিমাণ সদকা করার সওয়াব পাবে’ (ইবনে মাজ : ২৪১৮)।
ঋণ মাফ করার ফজিলত
কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম হলো অভাবি ও অসচ্ছল ঋণগ্রস্তদের ঋণ মাফ করে দেওয়া।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে এক লোকের হিসাব গ্রহণ করা হয়; কিন্তু তার মধ্যে কোনো ধরনের ভালো আমল পাওয়া যায়নি। কিন্তু সে মানুষের সঙ্গে লেনদেন করত এবং সে ছিল সচ্ছল। তাই দরিদ্র লোকদের মাফ করে দেওয়ার জন্য সে তার কর্মচারীদের নির্দেশ দিত।’
রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ (ফেরেশতাদের) বলেন, ‘এ ব্যাপারে (অর্থাৎ তাকে ক্ষমা করার ব্যাপারে) আমি তার চেয়ে অধিক যোগ্য। একে ক্ষমা করে দাও’ (মুসলিম : ১৫৬১)।
অন্য এক বর্ণনায় আবদুল্লাহ ইবনে আবী কাতাদা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু কাতাদা (রা.) তার এক ঋণগ্রহীতাকে খুঁজলে সে আত্মগোপন করল। পরে তাকে পাওয়া গেল। তখন সে বলল, আমি অসচ্ছল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর কসম? সে বলল, আল্লাহর কসম (আমি অসচ্ছল)!
আবু কাতাদা (রা.) বললেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যার পছন্দ যে আল্লাহ তাকে কেয়ামতের বিপদগুলো থেকে মুক্তি দিন সে যেন অসচ্ছলকে সুযোগ দেয় অথবা মাফ করে দেয়’ (সহিহ মুসলিম : ১৫৬৩)।
ঋণগ্রহীতাকে কষ্ট না দেওয়া
কর্জে হাসানার উপরিউক্ত ফজিলত লাভের প্রধান শর্ত হলো, ঋণ দেবে শুধু ওই ব্যক্তির উপকার করার স্বার্থে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকলে বর্ণিত সওয়াব হাসিল হবে না। তাই ঋণগ্রহীতাকে কোনো ধরনের খোঁটা বা অন্য কোনোভাবে কষ্ট দেওয়া যাবে না। কেননা খোঁটা দেওয়ার দ্বারা আমলটির সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়। অথচ সওয়াব অর্জনই এর একমাত্র উদ্দেশ্য।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, খোঁটা ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদকাকে সেই ব্যক্তির মতো নষ্ট কোরো না, যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত এ রকম- যেমন এক মসৃণ পাথরের ওপর মাটি জমে আছে, অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ে এবং সেটিকে (আবার) মসৃণ পাথর বানিয়ে দেয়। এরূপ লোক যা উপার্জন করে তার কিছুই তাদের হস্তগত হয় না। আর আল্লাহ কাফেরদের হেদায়েতে উপনীত করেন না’ (সুরা বাকারা : ২৬৪)। আল্লাহ তায়ালা আমাদের আমল করার তওফিক দান করুক।
সন্তান লাভের দোয়া ও আমল