নদীর জল তখনো ঘুমিয়ে। চারদিক ঘন অন্ধকারে মোড়া। শুধু মাঝে মাঝে ভেসে আসে নৌকার হাল ঠেলার ছলাৎ শব্দ। ধীরে ধীরে আকাশ ফিকে আলোয় জেগে উঠতেই চিরাপাড়া ব্রিজের নিচে প্রাণ পায় এক অদ্ভুত বাজার। যেটি ‘ভাসমান ধানের চারা (বীজ) হাট’ নামে পরিচিত।
শুক্র ও সোমবার-সপ্তাহে এই দুই দিন জমজমাট থাকে বীজের হাট। এই দুই দিন সূর্য উঠার আগেই চিরাপাড়া নদী রঙিন হয়ে ওঠে সবুজের বুননে। হাটের সকাল ৬টা পর্যন্ত থাকে জমজমাট। হাটের আগের দিন শত শত নৌকা, ভ্যান আর অটোরিকশায় বোঝাই ধানের চারা এসে থামে নদীর পাড়ে। ভোররাত থেকে শুরু হয় কেনাবেচা। তখন চারিদিক থেকে ভেসে আসে দরদামের হাঁকডাক।
নদীর তীরে কান পাতলেই বিক্রেতাদের তখন বলতে শোনা যায়- ‘চারা লাগবে, ভালো চারা!’ এ যেন বীজের ভাসমান বাজার নয়, রীতিমতো নদীর বুকে কৃষির আরেক উৎসব।
চাষের প্রস্তুতি
মৌসুমের শুরুতে টানা বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতায় ভুগেছেন কৃষকরা। অনেকের বীজতলা ডুবে গেছে। অনেকেই বীজতলা ঠিকমতো তৈরি করতে পারেননি। অথচ আমন মৌসুমে জমি ফাঁকা রাখা মানে বছরের এক বড় ক্ষতি। জমি রোপণের সময় চলে যাচ্ছে, অথচ চারা নেই বীজতলায়। তখনই ভরসা হয়ে দাঁড়ায় কাউখালীর এই বীজের ভাসমান হাট।
পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার জমি তুলনামূলক উঁচু আর নদীবেষ্টিত। তাই অতিবৃষ্টি কিংবা জোয়ারের পানিতে বীজের ক্ষতি হয় না। তাছাড়া নদীর চরাঞ্চলে বীজ বোনা হয়। উঁচু জোয়ারে চরাঞ্চল পানির নিচে চলে গেলেও তা আবার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে স্বরূপে ফিরে আসে। থাকে না জলাবদ্ধতার ভয়। তাই এখানকার চারা দেশি জাতের লম্বা, শক্ত আর টেকসই। সে কারণেই ভান্ডারিয়া, নাজিরপুর, নেছারাবাদ, রাজাপুরসহ দূর-দূরান্ত থেকে কৃষকরা ছুটে আসেন ভাসমান এই হাটে।
সাশ্রয় আর নিশ্চয়তা
নৌকার ভিড়ের ভেতরে শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) ভোরে রাজাপুরের কৃষক জসিম হাওলাদারকে পাওয়া গেলো। কপালে ঘাম মুছতে মুছতে তিনি বললেন, ‘নিজে বীজতলা করলে অনেক খরচ, আবার সময়ও লাগে। অধিকাংশ সময় বীজ পানিতে পচে যায়। তাছাড়া বীজ তোলার শ্রমিকও পাওয়া যায় না। কিন্তু এই ভাসমান হাট থেকে চারা কিনে নিলে ঝামেলা কম, জমিতে চারার শেকড় দ্রুত ছড়িয়ে যায়।’
কৃষক জসিম পাশের নৌকায় বীজ কিনছিলেন স্বরূপকাঠির সুভাষ রায়। তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘আমাদের জমি নিচু। জলাবদ্ধতায় বীজতলা নষ্ট হয়। তাই বছরের পর বছর এখান থেকেই চারা কিনতে আসি। গতবছরের চেয়ে দাম একটু বেশি হলেও বীজের মান ভালো।’
ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো বীজের বাজার দর। তাদের ভাষ্যমতে, এক পোন (৮০ মুঠো) চারা বিক্রি হয়েছে ১২০০-১৮০০ টাকায়। দর কষাকষি চলে, তবু কৃষকের মুখে ভরসার ছাপ দৃশ্যমান। আর তার নেপথ্যের কারণ হচ্ছে বীজের গুণগতমান। কৃষকরা বলছেন, ভালো চারা মানে ভালো ফসল।
নতুন প্রজন্মের হাতছানি
কৃষি কর্মকর্তা সোমা রাণী দাস বললেন, ‘কাউখালীর কৃষকরা এখন শুধু নিজের জমির জন্য নয়, বাণিজ্যিকভাবে বীজতলা করছেন। এ বছর ভাসমান হাট থেকে প্রায় ২৪ লাখ টাকা আয় হয়েছে। দেখে তরুণ সমাজও কৃষিকে ব্যবসা হিসেবে ভাবছে।’
কৃষি কর্মকর্তার বক্তব্যের সত্যতা মিলল কাউখালীর ভাসমান বীজের হাটে। চোখে পড়ল, তরুণ কৃষকরা চারা গুনছে, ক্রেতার সঙ্গে দর কষাকষি করছে। কারও হাতে স্মার্টফোন, কেউ লাইভ করছে হাটের দৃশ্য। নদীর বুকের এই সবুজ ভাসমান বাজার যেন আধুনিক উদ্যোক্তাদের নতুন প্ল্যাটফর্ম।
পর্যটন সম্ভাবনা
কাউখালীর পরিবেশকর্মী রবিউল হাসান রবিন বলেন, চিরাপাড়া নদীর বুক ভেসে উঠেছে সবুজে। নৌকা ভর্তি ধানের চারা, কৃষকের হাঁকডাক আর ভোরের বাতাসে ভেসে আসা মাটির গন্ধ। এই সব মিলিয়ে ভাসমান বাজারে অন্যরকম প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে। বাজার ঘিরে কৃষি পর্যটন গড়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষক ঐক্য ফাউন্ডেশন পিরোজপুর জেলা শাখার সভাপতি আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, কাউখালীর এই চারার হাট কেবল কৃষির বাজার নয়, গ্রামীণ জীবনের উৎসব। প্রতিটি লম্বা চারা যেন কৃষকের স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। নদীর ঢেউয়ের মতো এগিয়ে চলেছে কৃষির সম্ভাবনা, নতুন আশায় ভর করে।
তাড়াশে অবাধে পুকুর খনন, কমছে কৃষি জমি
লালপুরে কৃষি অধিদপ্তরের পরিত্যক্ত ভবনসহ জমি দখলের চেষ্টা
বন্যায় এক জেলাতেই প্লাবিত ৬ হাজার হেক্টর কৃষি জমি