সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার অধিকাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর। সারা বছর ধান, গম, পাট ও বিভিন্ন সবজি জাতীয় কোনো না কোনো ফসল উৎপাদন করেন তারা। কিন্তু হঠাৎই তাড়াশে যত্রতত্র অনিয়মতান্ত্রিকভাবে তিন ফসলি ও দুই ফসলি কৃষি জমিতে পুকুর কাটা শুরু করে প্রভাবশালীরা। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে এই উপজেলার ফসলি জমি। এভাবে চলতে থাকলে খাদ্য সংকট দেখা দেবে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
এলাকাবাসী, কৃষক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ বছরে প্রায় পাঁচ হাজার পুকুর খনন করেছে প্রভাবশালীরা। যা আগে ছিল ৩১০০টি। বর্তমানে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২৮০টিতে। মৎস্য চাষ লাভজনক হওয়ায় প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে তিন ফসলি জমিতে পুকুর খনন করা অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে যত্রতত্র পুকুর কাটায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় কৃষকরা সময়মতো ফসল আবাদ করতে পারছেন না। ফলে গত ৭ বছরে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমে গেছে। এতে খাদ্য ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন প্রান্তিক কৃষকরা।
প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন কর্মকাণ্ড চললেও তা দেখার কেউ নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা।

কৃষক ফিরোজ হোসেন জানান, তাদের এই বিলে আগে বছরে তিনটি ফসল হতো। এখন তারা একটি ফসলও ঠিকমতো তুলতে পারছেন না। কারণ জলাবদ্ধতার কারণে পানিতে ডুবিয়ে যায়। এই জলাবদ্ধতার কারণে হাজার হাজার বিঘা জমি পানিতে তলিয়ে থাকায় ফসল চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। যাদের বেশি জমি, তারা পুকুর কাটছে। কিন্তু তাদের জমির পরিমাণ অল্প। এখন আবাদ করবেন। কিন্তু জমি তৈরি করতে পারছেন না। প্রশাসনকে জানালে তাৎক্ষণিক বন্ধ হলেও স্থায়ীভাবে বন্ধ হচ্ছে না।
আব্দুল জলিল নামের আরেক কৃষক জানান, তার জমিটি অন্য একজনের পুকুরের পাশে। অন্য জমির মালিক তাদের জমি বেশি হওয়ায় জমিতে পুকুর কেটেছেন। কিন্তু তার জমি অল্প, তাই তিনি চরম বিপদে পড়েছেন। এখন তার জমিতে কোমড় সমান পানি। পানির মধ্যে জমি পরিষ্কার করতে তার বিঘাতে ৮-১০টা করে শ্রমিক বেশি লাগছে। এভাবে ধান আবাদ করে তাকে লোকসান গুনতে হয়।
আগে জোলা ছিল, কিন্তু জোলা নেই। তাই বাধ্য হয়ে নিজের খাওয়ার জন্য হলেও চাষ করতে হচ্ছে তাকে। এভাবে চলতে থাকলে তাদের চরম বিপদ হবে বলে জানান এই কৃষক।
কৃষক রফিকুল ইসলাম, গোলাম হোসেন ও আহমদ আলী জানান, এভাবে পুকুর কাটা চলতে থাকলে এক সময় দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিবে। পুকুর কাটার কারণে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে তারা ঠিকমতো আবাদ করতে পারছেন না। আর যদি আবাদ না হয় তাহলে তো শতভাগ খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবেই। বর্তমানে তিন ফসলি জমিতে প্রচুর পুকুর কাটা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে প্রশাসনকে জানালে তারা এসে ভেকুর ব্যাটারি নিয়ে যাচ্ছে। এতে ২-১ দিনের জন্য বন্ধ হলেও স্থায়ীভাবে বন্ধ হচ্ছে না। যদি বন্ধ না হয় তাহলে তিন ফসলি জমির আরও খুব ক্ষতি হবে। তাই প্রশাসনের স্থায়ীভাবে পুকুর খনন বন্ধ করা প্রয়োজন। এছাড়াও একটি পুকুর কাটার অনুমতি এনে তারা তিন চারটি পুকুর খনন করে। আবার প্রতিবাদ করলে তারা ভয়ভীতি দেখায় ও হুমকি দেয়।
উপজেলা অতিরিক্ত মৎস্য কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম জানান, তাড়াশ মৎস্য চাষে অত্যন্ত সমৃদ্ধ উপজেলা। এখান কার্ফ জাতীয় মাছ বড় করা হয়। এখান থেকেই প্রথম রুই ও কাতল মাছ বড় করা হয়। এখানকার চাষিরা মাছ চাষ করে বেশ লাভ করতে পারছে। ৭ বছর আগে পুকুরের সংখ্যা ছিল ৩১০০টি। বর্তমানে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫২৮০টি। মাছ চাষ বেশ হচ্ছে কারণ মাছ চাষ বেশ লাভজনক। এখানকার প্রায় ৩৪ হাজার মেট্রিক টন মাছ চাহিদা মিটিয়ে মাছ বাহিরে যাচ্ছে। এমনকি ময়মনসিংহসহ হাওর সমৃদ্ধ জেলায় যাচ্ছে। কারণ তাড়াশের মাছ বেশ স্বাদযুক্ত ও রং অনন্য। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় চাহিদা রয়েছে।
এ জন্য মাছ বিক্রির জন্য চাষিদের বেগ পেতে হয় না। অন্যান্য চাষের সাথে তুলনা করলে মাছ চাষ খুব লাভজনক। কিন্তু পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নের দিকে খেয়াল রেখে কৃষকদের তিন ফসলি জমিতে পুকুর কাটা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান এই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শর্মিষ্ঠা সেন গুপ্তা বলেন, প্রতি বছর আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, কৃষি বিভাগের এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে কীভাবে অল্প আবাদি জমিতে অধিক ফসল ফলানো যায়। প্রতি বছর রাস্তা-ঘাট, ঘড়-বাড়ি, বিভিন্ন স্থাপনা, ইটভাটা ও পুকুর কাটায় এই আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ভালো জমিতে বিশেষ করে তিন ফসলি ও দুই ফসলি জমিতে কেউ ইট ভাটা ও পুকুর খনন করতে না পারে সে জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছি। কিছুটা কমলেও যাতে ভালো জমিতে উচ্চ ফলনশীল ও উন্নত জাত, রোগ প্রতিরোধক জাতগুলোর ব্যবহার কীভাবে করা যায় কৃষি বিভাগ সে ব্যাপারে কৃষকের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
গত ৫ বছরে উপজেলায় প্রায় ৫০ হেক্টর আবাদি জমির পরিমাণ কমে গেছে। কৃষি বিভাগ চায়, আর যাতে আবাদি জমি না কমে। কিছুটা কমলেও যাতে অল্প জমিতে বেশি বেশি ফসল ফলানো যায় সে ব্যাপারে কৃষকদের পাশে থেকে সেবা দিয়ে যাবে কৃষি বিভাগ।
চাঁদপুরে প্রতিদিন ৫০০ মণ ইলিশ সরবরাহ