চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে আগাম শীতের সবজির ফলনে মুখে হাসি ফুটেছে কৃষকদের। বর্তমানে ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে উপজেলার সব হাট-বাজারে পাওয়া যাচ্ছে টাটকা সব ধরনের শাকসবজি।
কৃষকদের দাবি, অনুকূল আবহাওয়া, জমির উর্বরতা ও কৃষি অফিসের পরামর্শে এ বছর সবজির ফলন বিগত বছরের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে ফটিকছড়ি উপজেলার প্রায় ৬ হাজার ১০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ হয়েছে, যেখানে ১২ হাজারের বেশি কৃষক সরাসরি যুক্ত। এর মধ্যে ১ হাজার ১০০ জন কৃষককে বিভিন্ন মেয়াদে সরকারি প্রণোদনা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া ৩৫০ জন কৃষককে উন্নত জাতের লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শসা ও বেগুনের বীজ এবং ৭৫০ জন কৃষককে বীজ ও সার প্রদান করা হয়েছে। রবি শস্য চাষে উৎসাহ দিতে আরও ৭৩০ জন কৃষককে অতিরিক্ত প্রণোদনা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে উপজেলা কৃষি অফিস।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, কৃষকদের সার সহায়তায় এ বছর ডিএপি ও এমওপি সার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
শনিবার (১ নভেম্বর) সরেজমিনে ঘুরে প্রান্তিক কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর সীম, টমেটো, বেগুন, কপি, লাউ, শসা, লাল শাক, মিষ্টি কুমড়া, চিচিঙ্গা, ঢেঁঢশ, মুলা, টমেটো, করোলা, ধনিয়া পাতাসহ মৌসুমী সবজি চাষে রেকর্ড সংখ্যক ফলনের আশা করছেন স্থানীয় কৃষকরা।
কৃষিবিদ ও স্থানীয়দের মতে, ফটিকছড়ির মাটির গুণগত মান ও ভৌগোলিক অবস্থান সবজি চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এখানকার সবজির মধ্যে বিশেষ করে বাহুবলি টমেটো, হিরো প্লাস টমেটো ও বর্ণালী জাতের টমেটো ফলন সবচেয়ে ভালো হয়।
উপজেলা কৃষি অফিসের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বিঘায় টমেটো চাষে ২০ হাজার টাকা খরচ করে প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার কেজি উৎপাদন সম্ভব হয় ফটিকছড়ির বিভিন্ন জায়গায়।
অন্যদিকে, বেগুন চাষেও ফটিকছড়ি শীর্ষে রয়েছে। বেগুনের জাতের মধ্যে এসব অঞ্চলে ছোলঝার, দৌয়াহাজারী ও গ্রিনবল জাতের বেগুন প্রতি বিঘায় ৪০–৪৫ হাজার টাকা খরচে ৩ হাজার কেজি পর্যন্ত ফলন দেয়। এছাড়া কপি চাষেও পিছিয়ে নেই ফটিকছড়ির কৃষকরা। কপির মধ্যে এখানে সাধারণত স্নো হোয়াইট, চমক ও আর্লি হোয়াইট জাতের কপি চাষ হয়। বিঘা প্রতি আড়াই থেকে ৩ হাজার কেজি পর্যন্ত কপি উৎপাদিত হয়, যার খরচ প্রায় ৫০ হাজার টাকার মধ্যে থাকে।

বাংলাদেশের একমাত্র উচ্চ ফলনশীল ‘নাদির মুলা’ উৎপাদিত হয় ফটিকছড়ির হালদা নদীর তীরে, যা দেশের অন্য কোনো এলাকায় এত বড় পরিসরে দেখা যায় না। একইভাবে, হালদা নদীর বালুচরে উৎপাদিত মিষ্টি আলু স্বাধ ও গুণগত মানে অনন্য।
ফটিকছড়ির শীর্ষ সবজি অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে- কাঞ্চননগরের (বেড়াজালি ও ছোমুরহাট) নাজিরহাট পৌরসভার (কুম্ভারপাড়া), খীরামের (হচ্চারঘাট), হারুয়ালছড়ির (লম্বা বিল) বাগানবাজার ও দাঁতমারার এলাকার মধ্যে (ধুলিয়াছড়ি ও মুসলিমপুর) সবচেয়ে এগিয়ে।
অন্যদিকে, বরবটি চাষে সেরা হিসেবে পরিচিত গুলিয়াছড়ি। পাশাপাশি নারায়ণহাট, ভূজপুর ও সূয়াবিলের মতো এলাকাগুলোও শীতকালীন সবজি উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।
শনিবার সকালে ফটিকছড়ি বিভিন্ন জায়গায় সরেজমিনে ঘুরে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নাজিরহাট পৌরসভায় এবার লাল শাকের বাম্পার ফলন হয়েছে।
কুম্ভারপাড়ার কৃষক পূর্ণচন্দ্র নাথ তার আবাদি জমি দেখিয়ে বলেন, এ বছর আমরা উপজেলা কৃষি অফিস থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা পেয়েছি। আমি লালশাক, মিষ্টি কুমড়া ও লাউ চাষ করছি। লালশাক বিক্রি করে ভালো মুনাফা পেয়েছি, প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি করতে পেরে লাভবান হয়েছেন বলে জানান তিনি।
কাঞ্চননগরের কৃষক ওসমান গণির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ও তার স্ত্রী বলেন, এ বছর বড় কোনো ঝড়-বৃষ্টি না থাকায় ফসলের ক্ষতি হয়নি। তাই সবজি চাষে ভালো লাভের আশা করছি। একই আশাবাদ ব্যক্ত করেন স্থানীয় কৃষক হানিফ, রবি, নাজিম ও লোকমানও।

ফটিকছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবু সালেক বলেন, এ পর্যন্ত শীতকালীন সবজির অবস্থা খুবই সন্তোষজনক। যেসব এলাকায় ভালো সবজি চাষ হচ্ছে, সেসব এলাকার কৃষকদের প্রণোদনা প্রদান ও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার কাজ চলছে। আমরা চাই, কৃষকরা যেন সবজি চাষে আরও উৎসাহিত ও লাভবান হন। সব মিলিয়ে, এ বছর এখন পর্যন্ত অনুকূল আবহাওয়া, সঠিক পরিকল্পনা, সরকারি সহায়তা ও কৃষকদের নিবেদিত প্রচেষ্টায় ফটিকছড়ি উপজেলায় শীতকালীন সবজির ফলন ভালো। বাজারে সরবরাহ বেড়েছে, দামও রয়েছে সাধারণ ক্রেতার নাগালে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বরবটি বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়, চিচিঙ্গা ৪০ টাকা, লাউ ৩০ টাকা, পটল ৪০ টাকা এবং অন্যান্য শাক-সবজি দামও ক্রেতার নাগালের মধ্যে। এ দামে বিক্রি হলেও কৃষক সন্তুষ্ট এবং লাভের আশা করছেন বিক্রেতারা।
মাবুদ নামের এক বিক্রেকা বলেন, সবজি নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো কৃষক বা ক্রেতার অভিযোগ পাইনি।
মো. আরিফ নামের একজন ক্রেতা বলেন, বর্তমান বাজার দরে আমরা সন্তুষ্ট। আমাদের কৃষকদের স্বার্থও দেখতে হবে, যাতে তারা চাষাবাদ করে ক্ষতিগ্রস্থ না হন। ফলে এ পর্যন্ত ফটিকছড়ির কৃষক ও ভোক্তা উভয়েই উপকৃত হচ্ছেন এ মৌসুমে।
