ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের শেষ আশ্রয় হাজারিখিল অভয়ারণ্য

আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:০৬ পিএম

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এখন বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের শেষ আশ্রয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পাহাড় আর ঘন সবুজ বনভূমির এই অভয়ারণ্যে লুকিয়ে আছে প্রকৃতির এক অপার রহস্য— মায়া হরিণ, অজগর, কচ্ছপ, বুনো বিড়াল, গেছো বাঘ, খেকশিয়াল, নানা প্রজাতির পাখিসহ সর্বোপরি মহাবিপন্ন বনরুইয়ের উপস্থিতি এখনো টিকে আছে এই বনে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বর্তমানে অভয়ারণ্যের কালাপানি ছড়া ও পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে এসব বিরল প্রাণীর দেখা মেলে। সূর্যাস্তের পর নীরব পাহাড়ি অন্ধকারে এদের অবাধ বিচরণে যেন প্রকৃতি নিজের ছন্দে জেগে ওঠে।

বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, অনেক প্রাণী নিশাচর স্বভাবের হওয়ায় দিনে দেখা না গেলেও রাতে তারা সক্রিয় থাকে। বিশেষ করে বনরুই সাধারণত ৮ থেকে ১০ ফুট গভীর গর্তে বাসা বানিয়ে থাকে এবং সূর্যাস্তের পর খাবারের সন্ধানে বের হয়। পিঁপড়া, উইপোকা ও ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ এদের প্রধান খাবার।

স্থানীয়দের মতে, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের ইতিহাসে হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এক অনন্য নাম। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার সীমান্তজুড়ে বিস্তৃত এ বনভূমি এখন মহাবিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের জন্যও এখানে রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা।

২০১৫ সালে প্রকাশিত আইইউসিএন বাংলাদেশ–এর “রেড লিস্ট অব বাংলাদেশ”-এ দেশীয় ২ প্রজাতির বনরুই—চায়না বনরুই ও ভারতীয় বনরুই—কে ‘মহাবিপন্ন’ (Critically Endangered) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিলুপ্ত হলেও, হাজারিখিলের পাহাড়ি জঙ্গলে এখনো তাদের টিকে থাকার লড়াই চলছে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১,১৭৭ দশমিক ৫৩ হেক্টর পাহাড়ি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অভয়ারণ্য চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল সরকার এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে।

অভয়ারণ্যের রেঞ্জ কর্মকর্তা সিকদার আতিকুর রহমান বলেন, হাজারিখিল দেশের বন্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এক বিরল পাহাড়ি অঞ্চল। বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র এখানেই মহাবিপন্ন বনরুইয়ের দেখা মেলে। বিশেষ করে কালাপানি ছড়া পয়েন্ট ও আশপাশের পাহাড়ে সন্ধ্যার পর বনরুইকে অবাধে বিচরণ করতে দেখা যায়।

বন্যপ্রাণী গবেষক ও পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, হাজারিখিল অভয়ারণ্য এখন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে প্রায় ১৫০ প্রজাতির পাখি, ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী নিরাপদে বসবাস করছে। পাশাপাশি রয়েছে প্রায় ২৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ। এই অভয়ারণ্য কেবল প্রাণীদের আবাস নয়, এটি প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার এক জীবন্ত দুর্গ।

তিনি আরও বলেন, বনরুইয়ের মতো বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী এখানে টিকে আছে, এটাই আমাদের জন্য আশার আলো। এ সংরক্ষণ কার্যক্রম টিকিয়ে রাখতে হলে স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।

ফটিকছড়ি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে যেখানে দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণ, সেখানে হাজারিখিল যেন প্রকৃতির এক শেষ দুর্গ। বনরুইয়ের মতো মহাবিপন্ন প্রাণ এখনো এখানে জীবনের স্পন্দন ছড়াচ্ছে। বন বিভাগ, স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশবিদদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে আমরা আবারও ফিরে পেতে পারি আমাদের হারানো জীববৈচিত্র্যের গৌরব।

প্রকৃতিপ্রেমী ও গবেষকদের মতে, হাজারিখিলের পাহাড়ি জঙ্গল বর্তমানে বাংলাদেশের একমাত্র এলাকা যেখানে বনরুইকে দেখা যায়। রাতে কালাপানি ছড়া ও সংলগ্ন টিলাগুলিতে এই আঁশওয়ালা নিরীহ প্রাণী খাবারের সন্ধানে বের হয়।

তাদের দাবি, বন্য প্রাণীদের নিরাপদে বেঁচে থাকার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও বনরক্ষীদের নিয়মিত পাহারা ও নজরদারি প্রয়োজন।

NJ
আরও পড়ুন