প্রবাদে আছে, বিল দেখতে চলন, গ্রাম দেখতে কলম। ষড়ঋতুর এই দেশে চলনবিলকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা যায়। বর্ষায় বিশাল জলরাশি বুকে নিয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে এ বিল। শরতে শান্ত জলরাশির ওপর ছোপ ছোপ সবুজ রঙের খেলা। হেমন্তে পাকা ধান আর মাটির গন্ধে ম ম করে চারদিক। শীতে হলুদ আর সবুজের সমাহার এবং গ্রীষ্মে চলনবিলের রূপ হয় রুক্ষ। চলনবিলের মূল আকর্ষণ নৌকাভ্রমণ।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল হলো এই চলনবিল। ৩টি জেলাজুড়ে এর বিস্তৃতী। সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর জেলার অংশজুড়ে যে জলভূমি বর্ষা এবং বর্ষাপরবর্তী সময়ে দেখা যায় সেটাই বিখ্যাত চলনবিল।
শুকনো মৌসুমে এসব বিলে পানি থাকে না। তখন চাষাবাদ চলে বিলের জমিনে। তবে বর্ষায় কানায় কানায় পানিতে পূর্ণ হয়ে রূপের পসরা সাজিয়ে বসে। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলনবিল ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। ব্রহ্মপুত্র নদ যখন তার প্রবাহপথ পরিবর্তন করে বর্তমান যমুনায় রূপ নেয়, সে সময়েই চলনবিলের সৃষ্টি।
চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১ হাজার ৮৮ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে এর আয়তন অনেক কমে এসেছে। আসলে চলনবিল অনেকগুলো ছোট ছোট বিলের সমষ্টি। বর্ষায় এই বিলগুলোতে জলপ্রবাহ বেড়ে এরা একসঙ্গে বিশাল এক অখণ্ড বিলের রূপ নেয়।

সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া এবং নাটোর জেলার সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলাজুড়ে এ বিলের বিস্তৃতী।
বর্ষাকালে প্রকৃতির অপরূপ রূপে সাজে এ বিল। চারদিকে শুধু পানি থৈ-থৈ করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা ভিড় করেন চলনবিলে। এই ভরা বর্ষা মৌসুমেও সেটাই ঘটছে। এ মুহূর্তে দিগন্ত প্রসারিত টলমল জলে অপরূপ সাজে সেজেছে চলনবিল। সারাদেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের মতোই একটি দর্শনীয় স্থান চলনবিল।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন অর্থাৎ শুক্রবার দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এ অঞ্চলে ছুটে আসেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিদিনই ভিড় জমে এ বিলে। মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস এমনকি রিকশায় চড়ে হাজারো মানুষকে আসতে দেখা যায় চলনবিল এলাকায়।
শুক্রবার বিকেল হলেই বিভিন্ন পর্যায়ের চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা চলে আসেন আনন্দ উপভোগের জন্য। শ্যালো নৌকা, বৈঠা-নৌকা, পালতোলা নৌকায় ঘুরতে দেখা যায় ভ্রমণপিপাসুদের।
বিশালতার দিকে থেকে চলনবিল দেশের অন্যতম বড় বিল। যান্ত্রিক জীবনের প্রশান্তি আনতে বাংলাদেশের বৃহত্তর বিল চলনবিলে নৌকা ভ্রমণে আগ্রহ বেড়েছে পর্যটকদের। চলনবিলের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে এবং ভরা বর্ষায় পর্যটকদের নির্মল বিনোদন ও চলনবিলকে উপভোগ করার বাসনায় যেতে হবে নাটোরের গুরুদাসপুরে খুবজিপুর গ্রামে চলনবিল জাদুঘরে।
এই জাদুঘরটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ। সেখানে রয়েছে চলনবিলের হাজার বছরের কৃষ্টিকালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা দর্শন। বর্তমানে জাদুঘরটি সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালতি হচ্ছে।
পাশের সিংড়া উপজেলায় রয়েছে ঘাসি দেওয়ানের মাজার, তাড়াশ উপজেলায় রয়েছে জমিদার বাড়ি ও নওগাঁয় রয়েছে শাহ্ শরীফজিন্দানী (রা.) মাজার শরীফ। আর নাটোর সদরে রয়েছে উত্তরা গণভবনসহ রানীভবনীর স্থাপনা।
চলনবিলের বুক চিরে বয়ে চলা –হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের ৯ ও ১০ নম্বর ব্রিজ এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও বর্ষায় অসাধারণ হয়ে ওঠে। বর্ষায় এসব এলাকায় রাস্তার উভয় পাশেই দেখা মেলে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির।
এর পাশেই বিশাল জলরাশির মাঝে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন পার্ক। বেহুলার স্মৃতিবিজড়িত বেহুলার কূপ আজও আছে তাড়াশ উপজেলার বিনসাড়া গ্রামে। পাশে নৌকাসাদৃশ্য ঢিবি আছে। এ ঢিবির নিচে বেহুলার নৌকা রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন স্থানীয়রা।

চলনবিলে রয়েছে রায় বাহাদুরের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, দেশের বৃহত্তম গোবিন্দ মন্দির, কপিলেশ্বর মন্দির, বারুহাসের ইমাম বাড়ি, শীতলাইয়ের জমিদার বাড়ি, হান্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দির ও রায়গঞ্জের জয়সাগর দীঘি। চাটমোহরের হরিপুরে লেখক প্রমথ চৌধুরীর বাড়ি ও বড়াইগ্রামের জোয়াড়িতে লেখক প্রমথ নাথ বিশীর বাড়িসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান বুকে ধারণ করে আছে চলনবিল।
বিলপাড়ের তাড়াশের নবগ্রামে নওগাঁ শাহী মসজিদ (মামার মসজিদ) ও ভাগ্নের মসজিদ নামে দুটি মসজিদ রয়েছে। পাশেই হজরত শাহ শরীফজিন্দানীর (র.) মাজার। চাটমোহরের হান্ডিয়ালে শেঠের বাঙ্গালা ও শেঠের কুঠি মীরজাফরের সহচর জগৎশেঠের বিশ্রামাগার ছিল বলে লোকে এগুলোকে আজও ঘৃণার চোখে দেখে। হান্ডিয়ালে রয়েছে বুড়াপীরের দরগা। চাটমোহরের সমাজ গ্রামে শেরশাহর ছেলে বাংলার সুবেদার সলিমের নির্মিত সমাজ মসজিদ রয়েছে।
চলনবিলের সৌন্দর্যকে আরও আকর্ষণীয় করেছে বালিহাঁস, তিরমূল, বাটুলে, মুরগি, হাঁস, খয়রা, মানিকজোড়, ডুটরা, চাপাখি, লোহাড়াং, মেমারচ, বোতক, নলকাক, সাদা বক, কানাবক, ফেফি, ডাহুক, চখা, বকধেনু, ইচাবক, করা, কাছিচোরা, রাতচোরা, ভুবনচিলা, মাছরাঙা, পানকৌড়িসহ নানা প্রজাতির পাখি।
ষড়ঋতুর এই দেশে প্রতি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা যায় চলনবিলকে। রূপ বদলের এই বৈচিত্র্য শরতের চলনবিল এক ভিন্ন জগৎ। বর্ষার চলনবিলের রুদ্র মূর্তি এখন শান্ত, জলরাশি স্থির। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। নানা রঙের ফুল, হরেক রকম পাখির কলরব।
এ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ সাজ। তাই চলনবিলে নিরাপদে নৌকা ভ্রমণ করার জন্য শরৎই সবচেয়ে ভালো সময়। বিশেষ করে বর্ষার সময় এই বিলের বিশালতা বৃদ্ধি পায়। আবার গ্রীস্মে এই বিল তার অন্য রূপ ধারণ করে।
তবে চলনবিল যত রূপেই আমাদের কাছে দৃশ্যমান হোক না কেন, তার মধ্যে এর নৌকা ভ্রমণ অর্থাৎ অথৈ জলরাশির দৃশ্য আমাদের অন্তরে স্থায়ীভাবে গেঁথে থাকে। দ্বীপের মতো গ্রামগুলো যেন একেকটা ভাসমান বাজার। বর্ষায় এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া, গ্রাম থেকে শহর, স্কুল-কলেজসহ যোগাযোগের সব জায়গায় ভাসমান মানুষগুলোর নিত্য সঙ্গীই যেন ঐতিহ্যবাহী ডিঙি নৌকা। কোনোটা চলছে পাল উড়িয়ে, কোনোটা ঠেলা নৌকা, আবার কোনোটা স্টিলের তৈরি ইঞ্জিনচালিত।
সাংবাদিক ও লেখক সনাতন দাশ বলেন, এশিয়ার বড় বিল হচ্ছে চলনবিল। দেশের নানা প্রান্ত থেকে বর্ষায় চলনবিলের নির্মল আনন্দ উপভোগ করতে ছুটে আসেন পর্যটকরা। অবৈধ দখল এবং পোনা মাছ ধরার কারণে ঐতিহ্যবাহী চলনবিলের সৌন্দর্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
