সবার আগে সে-ই চলে গেলো। কত সুন্দর তরতাজা একটা প্রাণ। কতই আর বয়স! সবে সে এ বছর ২০২৫ সালে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। এই মাত্র রেজাল্ট পেলাম। তাসিন গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়েছে। এর আগে গত ১৪ জুন শনিবার একই কলেজের সাত বন্ধু গিয়েছিল সীতাকুণ্ড ঘুরতে। সহস্রধারা-০২ ঝরনা দেখা শেষ করে সবাই বাসায় ফিরবে। হঠাৎ কী চিন্তা করে বন্ধুদের কয়েকজনের মধ্যে লেকের পানিতে নামার আগ্রহ সৃষ্টি হলো। ওরা কেউ বুঝতে পারেনি যেখানে নামছে সেখানে পানি অনেক গভীর ও ঠান্ডা। ভালো কোনো দিকনির্দেশনাও ছিল না। দুর্ঘটনাক্রমে তাসিন সেই পানিতে হারিয়ে যায়। বাবা-মায়ের আদরের মানিক চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে তাকে নিয়ে পরিবারের সব স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে যায়। একটা সম্ভাবনাময় কিশোরকে হারালো পরিবার, সমাজ ও দেশ। মেধা, মননে, ধর্মপালন, ক্রীড়া ও প্রোগ্রামিং খুবই ভালো ছিল। স্বল্পভাষী, অতি নম্র ও অমায়িক ব্যবহারের জন্য এলাকার সব বয়সের মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিল। বন্ধু মহলেও ছিল জনপ্রিয়।
কখনো কেউ যখন আমাকে সুসন্তানের পিতা বলতো, তখন গর্বে বুকটা ভরে যেতো। স্রষ্টার কাছে নীরবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতাম।
ডিওএইচএস এলাকার মসজিদে ফজরের জামাতে ওর বয়সে শুধু তাসিনকে পাওয়া যেতো। একবার এক মুরুব্বির সঙ্গে নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে হেঁটে বাসায় পৌঁছে যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়েছে আর ওই ভদ্রলোক ভিজে যাচ্ছে। তাসিন সঙ্গে সঙ্গে একটা ছাতা নিয়ে বের হয়ে গেলো এবং ওই মুসুল্লিকে বাসায় পৌঁছে দিলো। এত ছোট বয়সে সুন্দর একটা ধার্মিক জীবন যাপন করতো, দেখলে অবাক লাগতো।
ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া ছেলেটা পড়ালেখার পাশাপাশি প্রোগ্রামিংয়ে ভালো ছিল। গণিত ও বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করতো, ভালো করতো। স্কুলে একবার উপস্থিত গল্প বলা প্রতিযোগিতা হয়। বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা হয়ে ঢাকা শিশু অ্যাকাডেমি থেকে পুরুস্কার প্রাপ্ত হয়।
খেলাধুলায়ও ভালো ছিল। স্কুলে ফুটবল, ক্রিকেট ও বাস্কেটবল খেলতো। ওর মৃত্যুর পর স্কুলের ছেলেরা আমার কাছে আসে। কয়েকজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকে, ওরা কিছুদিন পূর্বে ফুটবল প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে। তাসিন নাকি একাই দুটি গোল করে জয়ের সফলতা এনে দিয়েছিল।
গত বছর জুলাই-আগস্টের শ্রাবণ বিপ্লবের সময় সারাদেশে ছাত্র-জনতার উত্তাল আন্দোলন চলছিল। তাসিন তখন বারবার বাসা থেকে বেরিয়ে যেতো। সারাদিন খবর রাখতো ওর বয়সের বন্ধুরা কোথায়, কখন মিছিলে গেলো। কয়েকটা মিছিলে গিয়েছিল কাউকে কিছু না বলে। সারাদেশে কারফিউ ঘোষিত হলো। একদিন হঠাৎ ছুটে এসে বললো ওর এক বন্ধুর গায়ে গুলি লেগেছে, এখনই তাকে দেখতে যাবে বলে চলে গেলো।
চাকরিজীবী বাবা-মায়ের সন্তানদের ছোটবেলা থেকে দৈনন্দিন জীবনের অনেক বাস্তবতার সঙ্গে সংগ্রাম করে চলতে হয়। তাসিনের মা সরকারি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সময়ে চাকরিসূত্রে বিভিন্ন স্থানে বদলি হতো। ঘন ঘন স্কুল পরিবর্তনে লেখাপড়ায় মনোযোগ ও ধারাবাহিকতার সমস্যা হয় । সেই ছোটবেলা থেকে চট্টগ্রামে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা চলিয়ে যাওয়ার জন্য ছুটির দিনগুলোয় মায়ের বদলি স্থলে ছুটতে হতো।
কম্পিটার ও ইলেকট্রনিকের প্রতি দারুণ আগ্রহ ছিল তাসিনের। ওর কাছ থেকে নানাবিধ প্রযুক্তির নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যেতো। প্রোগ্রামিংয়েও ভালো ছিল।
ছোটবেলা থেকে খুব শান্ত, ভদ্র ও অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী ছিল। যেকোনো মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে পারতো। তাই একবার কেউ দেখলে ওর খবর নিয়ে বলতো আপনার ছেলেটা সত্যিই চমৎকার,
ও ভালো আছে তো।
একটা সম্ভাবনাময় উদীয়মান কিশোরকে পর্যটন স্পটের দুর্ঘটনায় হারানো সত্যিই কঠিন ও কষ্টের। বাংলাদেশের যত্রতত্র নতুন নতুন গড়ে ওঠা পর্যটন স্পটগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে জীবন নিরাপত্তা নির্দেশাবলি ও ব্যবস্থা থাকে না। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে প্রয়োজনে ভালোভাবে প্রতিবন্ধকতা দিতে হবে, যাতে সহজে কেউ যেতে না পারে । পর্যটকদের পানিতে জীবন সুরক্ষার লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বোট ও নিরাপত্তাসামগ্রী রাখতে হবে ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আগামী ২৫ জুলাই জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব পানিতে ডুবা প্রতিরোধ দিবস পালিত হবে। আমাদের দেশে বিষয়টা এখনো ততটা প্রচার পায়নি।
তাসিনের অনেক গুণ ছিল। নরম ও অমায়িক ব্যবহারের জন্য সবাই পছন্দ করতো। আমার এই জীবনে একটা কিশোরের জন্য এত মানুষকে কান্না করতে ও আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে দেখিনি। ওপারে ভালো থাকিস বাবা।
