মুখতাসার শায়েরি: ক্ষুদ্র কবিতার বিস্তৃত ভুবন

আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৩১ পিএম

কবিতা দীর্ঘ না হলে কি তার শক্তি কমে যায় কিংবা আবেদন হারায়? কবি সাখাওয়াৎ আনসারীর সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ ‘মুখতাসার শায়েরি’ তে আগ্রহী পাঠক এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। এ গ্রন্থে প্রকাশিত ৯৪টি শায়েরিতে কবির কাব্যপ্রতিভার এক নতুন দিক উদ্ভাসিত হয়েছে। ক্ষুদ্র কাব্যদেহে গভীর ভাবনা প্রকাশের এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। গ্রন্থটি নানা কারণে তাৎপর্যমণ্ডিত। গ্রন্থটির প্রধান বিশেষত্ব হলো এর দ্বিভাষিকতা। উর্দু ভাষায় মূল রচনা এবং তার সঙ্গে বাংলা অনুবাদ-এ যেন একসাথে দুই ভুবনের অভিজ্ঞতা। একই পৃষ্ঠায় ওপরে মূল উর্দু কবিতা এবং নিচে বাংলা অনুবাদ থাকায় বিদেশী ভাষার কাব্য-স্বাদ গ্রহণের পাশাপাশি পাঠক মাতৃভাষায় তার অর্থ ও আবেগ অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন। উর্দু মূল রচনার সঙ্গে বাংলা অনুবাদের সংযোজনে পাঠক এই বই থেকে দ্বৈত ভাষিক অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাবেন। উর্দু ভাষার শব্দরাজির সাথে পরিচয় লাভের পাশাপাশি এ ভাষার শ্রুতিমাধুর্য ও সৌন্দর্য যেমন অনুভব করা যায়, তেমনই আবার বাংলা অনুবাদে তার অর্থ ও আবেগ স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়। কবির বহুভাষিক দক্ষতার সন্ধান পাওয়া যায় এখানেই, কেননা বাংলা অনুবাদ মূল কবিতার ভাব যথাযথভাবে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। শব্দের মাধুর্য, বাক্যের বিন্যাস, ভাবের গভীরতা-সব মিলিয়ে এই গ্রন্থের ভাষা এক অনন্য পাঠ অভিজ্ঞতা প্রদান করে।

কবি সাখাওয়াৎ আনসারীর ‘মুখতাসার শায়েরি’ গ্রন্থে সবচেয়ে নজরকাড়া দিক হলো এর ভাষার প্রাঞ্জলতা ও গভীরতা। ক্ষুদ্র কবিতাগুলোর থিম যেন একেকটি ভাবের দরজা খুলে দেয়। ছোট আকারের কারণে কবিতাগুলো দ্রুত পড়া যায়, তবে ভাবের গভীরতা পাঠককে থামিয়ে দেয়, ভাবতে বাধ্য করে। পাঠক অনুভব করেন কবির শক্তিশালী অন্তর্দৃষ্টি ও দার্শনিকতাকে।

গ্রন্থটির মূল শক্তি নিহিত রয়েছে এর বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে। দর্শন, আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা, মানুষের দায়িত্ববোধ, সমাজ বাস্তবতা, প্রেমিক হৃদয়ের হাহাকার কিংবা রম্যের স্বাদ-সবকিছুই এখানে উপস্থিত। কোথাও কবি চিরন্তন সত্য উচ্চারণ করেছেন, কোথাও আবার মানুষের অন্তর্গত পরস্পরবিরোধিতার ছবি এঁকেছেন। পড়তে গিয়ে পাঠক কখনো হয়ে পড়েন গম্ভীর, কখনো আবার হাসির খোরাক খুঁজে পান।

সাখাওয়াৎ আনসারীর ‘মুখতাসার শায়েরি’ তাই কেবলই ক্ষুদ্র আকারের কাব্য নয়; এটি ভাষার সরলতায় নিহিত কবির গভীরতর এক জীবনদর্শন, যা পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে।

কবিতার দর্শন, নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা কিংবা মানুষের দায়িত্ববোধের পাশাপাশি এখানে ধরা দিয়েছে প্রেমিক হৃদয়ের হাহাকার, সমাজবাস্তবতার কড়া প্রতিচ্ছবি, নারীর স্বভাবের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ কিংবা আশাবাদী প্রেমিকের স্বপ্ন। কোথাও কবি গুরুগম্ভীর সত্য উচ্চারণ করেছেন, কোথাও আবার রম্যের মাধুর্যে পাঠককে হালকা হাসি উপহার দিয়েছেন। ফলে পাঠক কখনো আত্মবিশ্লেষণে নিমগ্ন হন, কখনো আবার একটুখানি বিরাম খুঁজে পান হাসির ছলে।

কবির জীবন দর্শনের সম্যক পরিচয় ফুটে ওঠে এমন একটি শায়েরি- যিন্দেগি এক ওয়াসি কিতাব হ্যায়, জিস কা সফ্‌হা তুমহারি যিন্দেগি কে হার দিন কি লা-যওয়াল দস্তাবেয। (অনুবাদ) জীবন এক বিশাল গ্রন্থ, যার এক একটা পৃষ্ঠা

তোমার জীবনের এক-একটা দিনের অক্ষয় দলিল। কবিতার মাধ্যমে কবি এখানে পাঠককে দিতে চেয়েছেন নৈতিকতার শিক্ষাও। যেমনটি নিচের শায়েরিতে আমরা পাই- যিয়াদা দৌলত কে মালিক বানে কি খাহেশ না করো, কিউঁ কে ইস সে তুম মঘরুর হো সাকতে হো। বহুত কম দৌলত কে বাওজুদ তুমহারে দিল মেঁ কাভি ভি খোদা কে লিয়ে নশুকরি পয়দা নাহো। (অনুবাদ) প্রচুর বিত্তের মালিক হতে চেও না, কারণ এতে  তুমি হয়ে যেতে পার দাম্ভিক। খুব অল্প বিত্তের অধিকারী হয়েও তোমার মধ্যে যেন কখনোই জন্ম না নেয় স্রষ্টার প্রতি অকৃতজ্ঞতাবোধ। মানুষ হিসেবে আমাদের যে আরও বহু দূর উত্তরণের প্রয়োজন রয়েছে তা কবি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন এভাবেই- কুরবানি কে মাক্বসাদ কি তফসির মে বহুত সে লোগ কেহতে হ্যাঁয়, ‘ক্বুরবানি কা আসল মতলব হ্যায় দিল কি হায়ওয়ানিয়াত কো কুরবানি করনা’। লেকিন ওহি লোগ দুসরে জানওয়ারোঁ কে আঁখো কে সামনে ক্বুরবানি কর কে দিল কি হায়ওয়ানিয়াত কা কিয়া হি খুবসুরত নিশান ছোড় কর চলে জাতে হ্যায়’। (অনুবাদ) কুরবানির উদ্দেশ্য বর্ণনায় অনেকেই বলে থাকে, ‘কুরবানির মর্মার্থ হলো মনের পশুত্বকে কুরবানি দেয়া’। তারাই আবার অন্য পশুর চোখের সামনে কুরবানি করে মনের পশুত্ব কুরবানির কী চমৎকার স্বাক্ষরই না রেখে চলে। কবির মাঝে বাস করা রোমান্টিক স্বত্বার আকুলতা ও হাহাকার ফুটে উঠেছে নিম্নোক্ত শায়েরিতে- জব নিঁদ নেহি আতি, তো ইয়াদেঁ আতি হ্যায়। জব ইয়াদেঁ আতি হ্যায়, তো তুম আতি হো। জব তুম আতি হো, তো উদাসি আতি হ্যায়। বে-নিঁদ উদাসি মে গুযর জাতি হ্যায় মেরি নকাম যিন্দেগি।(অনুবাদ) যখন ঘুম আসে না, তখন স্মৃতি আসে। যখন স্মৃতি আসে, তখন তুমি আস। যখন তুমি আস, তখন বিষাদ আসে। ঘুমহীন বিষাদে কেটে যায় আমার নিষ্ফল জীবন।

কেবলই হাহাকার নয়, প্রেমিক হৃদয়ের অনিঃশেষ আশার সন্ধান পাওয়া যায় এখানে- ইস দুনিয়া মে কুছ ভি দায়েমি নেহি হ্যায়। মুঝে ইস খেয়াল সে তাসাল্লি মিলতি হ্যায় কে তুম ভি এক দিন যরুর সমঝ যাওগে কে তুমহারি মেরে লিয়ে মুহাব্বতকি কমি ভি দায়েমি নেহি হ্যায়। (অনুবাদ) এ বিশ্বে কিছুই চিরস্থায়ী নয়। এই ভেবে তৃপ্তবোধ করি যে তুমিও একদিন ঠিকই বুঝতে সক্ষম হবে যে আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাহীনতাও চিরস্থায়ী নয়।কবির রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায় বেশ কিছু অনবদ্য শায়েরিতে। তারই একটি-শোহর নে কহা, ‘চাল্লিস সাল সে হাম সংসার কর রাহে হ্যায়, লেকিন তুম নে মেরি এক ভি বাত সে ইত্তেফাক না কিয়া’। বিবি নে বোল উঠা, ‘একচাল্লিস’। (অনুবাদ) স্বামী বলল, ‘তোমার সঙ্গে চল্লিশ বছর ধরে সংসার করে যাচ্ছি, অথচ আমার কোনো একটি কথাতেও তুমি একমত হলে না’। স্ত্রী বলল, ‘একচল্লিশ’। ক্ষুদ্র পরিসরেও গভীরতা তৈরি করার যে চ্যালেঞ্জ, সাখাওয়াৎ আনসারী তা সফলভাবে অতিক্রম করেছেন। তাঁর শায়েরি পাঠকের কাছে কখনো উপদেশ, কখনো প্রশ্ন, কখনো বা নিছক অনুভূতির প্রকাশ হয়ে আসে। প্রতিটি কবিতাই যেন একেকটি ক্ষুদ্র আয়না, যেখানে পাঠক নিজের জীবন, দায়িত্ববোধ, ভালোবাসা এবং সমাজের দ্বিচারিতার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান। শুধু ভেতরের বিষয় নয়, গ্রন্থটির বহিরঙ্গও পাঠককে আকৃষ্ট করে। উজ্জ্বল প্রচ্ছদ, পরিমিত অলংকরণ এবং নান্দনিক বিন্যাস গ্রন্থটিকে চিত্তাকর্ষক করে তুলেছে। বিভিন্ন শায়েরের ছবি সংযোজন পাঠককে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আগ্রহী করে তোলে। মানসম্পন্ন রঙিন কাগজের ব্যবহার ও মজবুত বাঁধাই বইটিকে শুধু সংগ্রহযোগ্যই নয়, দীর্ঘস্থায়ীও করেছে। কবি সাখাওয়াৎ আনসারী দেখিয়েছেন, কবিতা শুধু দীর্ঘকায় হলেই নয়, ক্ষুদ্র আকারেও মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিতে পারে। এ কাব্যগ্রন্থ পাঠককে জীবনের দিকে নতুন চোখে তাকাতে শেখায় । তাই পাঠকের কাছে এটি যেমন নতুন অভিজ্ঞতা, তেমনি বাংলা কাব্যচর্চায় এটি এক অভিনব সংযোজন হয়ে থাকবে। উর্দু ভাষার সমৃদ্ধ জগতের সাথে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে উর্দু সাহিত্যের চর্চায় মাইলফলক হয়ে থাকবে এই বইটি।

MH