অতল সবুজের সমুদ্র যে দেশ, যে দেশে অক্লান্ত বয় ধানসিঁড়ি নদীর জলের ধারা, যে দেশের কবি জীবনানন্দ দাশ, সেই দেশের কন্যা নাহিদা আশরাফী। তার কিছু গল্প তাকে এ অভিধায় অভিষিক্ত করার অক্লেশ দাবি রাখে বৈকি! তার গল্পগ্রন্থ- ১. মায়াবৃক্ষ ২. জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা ৩. ঝুলবারান্দা তিনটি মাছ আর একটি বিন্দুবর্তী জলাশয়।
‘ঝুল বারান্দা, তিনটি মাছ আর বিন্দুবর্তী জলাশয়’ নামটি চমকপ্রদ ও আধুনিক। তার প্রায় গল্পে আছে অদ্ভুত চমক। প্রথম গল্প ‘রক্তজবা, বারবারা ও কালো ফুলদানি’ গল্পে প্রেমিক তার দয়িতাকে এক একবার এক এক ফুলের নামে ডাকে কখনো জুঁইফুল, কখনো বকুল, মাধবীলতা, বেলি! করোনায় মারা যাওয়া প্রেমিক গহনের জন্য বেদনাকাতর প্রেমিকার নিঃসঙ্গতা! সাদামাটা থিম, আবেগ উছলানো প্রেম একে বর্ণনার কারিশমায় সুরভিত করেছে লেখক। ‘অথচ যেখান থেকে গল্পটা শুরু হতে পারতো’ দ্বিতীয় গল্প। এ গল্পে সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি সঞ্চিত ক্ষোভ, যন্ত্রণাকে সরাসরি আঙুল তুলে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। গল্পের চেয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে দ্রোহ।
পরবর্তী গল্প ‘খুনী’ আমি বুঝতে পারি লেখক ঠোঁট গোল করে ‘খুনী’ শব্দটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। এ গল্পের খুনীর পরিচয় বের করতে স্বয়ং শার্লক হোমসও গলদঘর্ম হতেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
‘জয়নাল মিয়ার ৫৭০’ গল্পে অসাধারণ চরিত্রের নিপুণ ভাস্কর্য হয়ে উঠেছে জয়নাল মিয়া। গল্পের থিম, বর্ণনার মাধুর্য কিংবা নিপাট গল্প অবয়ব নির্মাণে নাহিদা পুরোপুরি শিল্পোত্তীর্ণ।
গ্রন্থের নাম গল্প ‘ঝুলবারান্দা তিনটি মাছ আর বিন্দুবর্তী জলাশয়’ পরাবাস্তব আর রহস্যের সঘন বুননে এ গল্পটি পাঠককে টান টান কৌতূহলে নাস্তানাবুদ করে তুলবে সন্দেহ নেই। তবে গল্পটি ভিন্নমাত্রা পেতো যদি এর সমাপ্তিতে পুলিশ, ছায়ামূর্তির অনুসরণজনিত ব্যাখা না থাকতো। আবারও বলবো, গল্পের খানিকটা রহস্য পাঠকের হাতে সমর্পণ করে দিলে ভালো হয়। গল্পে থাকুক ঝিনুকের অবগুণ্ঠনে, মুক্তো খোঁজার খানিকটা কৌতূহল! ‘পেনিলোপ সীতা ও আমি’ খুব ভালো লাগার গল্প। আমার অনুভূতি- এ গল্পটা অপরাজিতাদের গল্প, এ গল্পটা হতাশার চোরাবালি থেকে বেড়িয়ে আসার গল্প, মেয়েদের একটা খোলা জানালার গল্প। ‘প্রুফরিডার’ গল্পের প্রশান্ত বাবু আমাদের চেনা চরিত্র, এদের অসহায়ত্ব, হতাশাকে নাহিদা আন্তরিকতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছে। সাধারণ কহিনিকে ঝরঝরে ন্যারেটিভে সুখপাঠ্য করে তুলেছে। ‘বকুলের ঘ্রাণ’ স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরের মতো আত্মাহুতি দেওয়া শহীদ এক মুক্তিযোদ্ধার গল্প। জব্বার মাস্টারের দশ বছরের পুত্র বকুল। শ্বাসরুদ্ধকর, নির্মম হত্যাকাণ্ডের পৈশাচিক বর্ণনায় বুক অসহনীয় কষ্টে তোলপাড় হয়। পাঠককে লেখক যখন বোধের অতলে ডোবায়, ভাসায় তাই হলো লেখকের শক্তিমত্তা।
নাহিদার গল্প বলার ক্ষমতা আছে। সুর ও দম আছে। নাহিদার গল্প সুরেলা আর সুখপাঠ্য নির্দ্বিধায় এ কথা বলা যায়। কিছু গল্পে মাঝে মাঝে নাহিদার আবেগের উচ্ছ্বাস ছিপিখোলা স্যাম্পেনের মতো। আবার এ থেকে নাহিদা অক্লেশে বের হওয়ার ক্ষমতাও রাখে।
‘মধুময় বারোটা’ নিতান্তই এক প্রেমের গল্প। রোমান্টিক আবহ ও গভীর রসে এ গল্পকে নিতান্ত হালকাভাবে নিলে সে পাঠক মোটেও সুবিচার করবে না। প্রেমিকার ঋজু ও টান টান ব্যক্তিত্বে ভিন্নমাত্রা পেয়েছে এ গল্প। ‘মোনঘর’ এ নারীর স্বাধিকারের পরিস্ফুটন ঘটলেও গল্পটা একেবারে ট্রান্সপারেন্ট! গল্পের অবয়বে আরো নেকাবের দরকার ছিল।
‘প্রত্যাশিত প্রেমিক ও একটি চুম্বন’ অভিনব চরিত্রের বয়ানে সুলিখিত। করোনাকে চরিত্র করে লেখা এ গল্পটি পাঠকের হাত খপ করে ধরে ফেলে।
‘জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদের’ গল্পগ্রন্থে আছে চৌদ্দ অনুভবের চৌদ্দ কাহিনী। লেখক বৈচিত্র্য প্রিয়, এ ফর্মে বিশ্বাসী নাহিদা। ‘সাদা বাস কালো গাড়ি’ আবহমান কালের নারী বঞ্চনার গল্প। নারীর মনস্তাত্ত্বিক পোস্টমর্টেমে গল্পটা ঋজু। ‘বৃষ্টি ও শাড়ি’ গল্পটা পাঠককে প্রশ্ন চিহ্নে কোণঠাসা করতে করতে অবশেষে যে পরিণতিতে পৌঁছে দেয় তাতে ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত হয়। মিষ্টি সমাপ্তি টানা সুরেলা এ গল্প ‘তালেব বুড়ার বিজয় দর্শন’ গল্পের শুরু চিত্রময়তা দিয়ে। ‘পার্সেল’ এ লেখা ‘তনু’ নামটা মাঝবয়সী এক নারী হৃদয়কে খনন করে ফিরিয়ে নেয় তার সোনালি যৌবনে। গল্পটা সুখপাঠ্য। ‘মেয়েটি ও একটি অসম্পাদিত গল্প’ এর প্রারম্ভ এত মজবুত ও পরিণত যে এটি পড়ার জন্য আগ্রহী ওঠে পাঠকের মন। আর এর পরিণতি কী হতে পারে একেবারে শেষ না করে বিন্দুমাত্র অনুমান করা সম্ভব নয়। ‘ধারা বহমান’ গল্পটি প্রেমের। প্রেমের গল্প বাজারে বিকোয়, তবে ধীমান পাঠকের তৃপ্তি আনে। এ বইয়ের নাম গল্প ‘জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা’। গল্পের চমক শুরুতে ও সমাপ্তিতেও স্থিত আছে এ গল্পে। গল্পের কিছু বর্ণনা মুগ্ধ করে- ‘...একটু এগোলেই ধলার খালের একটা অংশ অযথা ধুম করে গ্রামের খানিকটা ভেতরে ঢুকে গেছে।’ গল্পটার হাত বেশ লম্বা। মন গভীর পাঠক দীর্ঘ সময় ধরে গল্পটি মনে মজুত করে রাখবে। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে আসে সবচেয়ে বড় আঘাত-এ বিষয়কে উপজীব্য করে লেখা ‘অমল ধবল শিউলি খালা’। দরদী বয়ানে লেখা এ গল্পটি পাঠকের মন ভেজাবে। গল্পের শেষে গান গাওয়া প্রসঙ্গটি বাদ রাখলে ভালো হতো।
এ গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য গল্প ‘হাওলাদার সাহেবের বিশ টাকা’ কৃপণ হাওলাদারের মনস্তাত্ত্বিক বর্ণনা গল্পকারের সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের মুন্সিয়ানার ছাড়পত্র দেয়। ‘বাবার চাদর’ গল্পটাকে চমৎকারভাবে জমিয়ে তোলার ক্ষমতা ছিল নাহিদার। ‘দ্বিতীয় ও শেষ চিঠি’ গল্পটি খুব নাটকীয়। ‘আলো-কথা’ গল্পটি মানবতার ধারক। ‘ডায়রি’ গল্পের প্রেম মন উদ্বেলিত করে। ‘নিরংশু দুপুরে আলোমুখি ফুল’ কী নান্দনিক নাম!
নাহিদার গল্প বলার ক্ষমতা আছে। সুর ও দম আছে। নাহিদার গল্প সুরেলা আর সুখপাঠ্য নির্দ্বিধায় এ কথা বলা যায়। কিছু গল্পে মাঝে মাঝে নাহিদার আবেগের উচ্ছ্বাস ছিপিখোলা স্যাম্পেনের মতো। আবার এ থেকে নাহিদা অক্লেশে বের হওয়ার ক্ষমতাও রাখে। নাহিদার কলমে শান আছে, আছে অপার শিল্পসত্তা। আশা করি নাহিদা কথাশিল্পে স্থিত হয়ে বাংলা কথাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে।
