ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

কাজী নজরুল ইসলাম : প্রসঙ্গ হামদ-না’ত ॥ মুহাম্মদ ইলিয়াছ

আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২৫, ০১:৫৫ পিএম

বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম বহুমাত্রিক প্রতিভা। তিনি প্রেম, বিদ্রোহ, মানবতা, সাম্যবাদ, ধর্মানুষঙ্গকে কবিতা, গান ও গদ্যে তুলে ধরেছেন অনন্যরূপে। তার  সাহিত্যকর্মে ইসলামি ভাবধারা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তিনি ইসলাম ধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকে হামদ (আল্লাহর প্রশংসা) ও না’ত (পবিত্র নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসায় রচিত কবিতা) রচনা করেন। এসব রচনার মাধ্যমে তিনি বাংলাভাষায় ইসলামি ভাবগানের এক বিশাল ভাণ্ডার সৃষ্টি করেছেন। ইসলামি ভাবধারায় তাঁর লেখা বহু কবিতা ও গান আজও মানুষের হৃদয়ে অনুরণিত। তাঁর কিছু গভীর ইসলামি চেতনার কবিতা ও গান আছে, যেগুলো বিশ্বাস, সাম্যবোধ, প্রেম ও প্রতিবাদী মনোভাব আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে।

নজরুল ইসলামের হামদগুলোতে মহান আল্লাহর অনুগ্র, মহিমা, করুণা, শক্তি ও মহানুভবতার প্রশংসা করা হয়েছে। তিনি যে কেবল ধর্মীয় আবেগ থেকেই হামদ লিখেছেন তাও কিন্তু নয়, বরং এগুলোর মাধ্যমে তিনি মুসলিমদের ধর্মীয় চেতনাকে সাহিত্যের মাধ্যমে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তিনি লিখেছেন—

আল্লাহ্ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়,
আমার নবী মোহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগৎময়।
আমার কিসের শঙ্কা, কোরআন আমার ডঙ্কা,
ইসলাম আমার ধর্ম, মুসলিম আমার পরিচয়।
[আল্লাহ্ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়, জুলফিকার, ১৯৩২, প্রথম সংস্করণ]

‘আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়’ এই পঙক্তিতে কবি তাঁর পরম বিশ্বাসের কথা বলেন—আল্লাহ তাঁর একমাত্র প্রভু, তাই তিনি কোনো কিছুতেই ভয় পান না। এটা ঈমানদারের এক দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও তাওহিদের ঘোষণা। আল্লাহই সর্বশক্তিমান, তাঁর ওপর ভরসা করলে মানুষ ভয়মুক্ত থাকে। ‘আমার নবী মোহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগৎময়।’ কবি মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স.)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। তিনি এমন একজন মহান ব্যক্তি, যাঁর প্রশংসা (তারিফ) সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। ইসলামের ইতিহাসে তিনি মানবজাতির মুক্তির বার্তাবাহক। ‘আমার কিসের শঙ্কা, কোরআন আমার ডঙ্কা,/ইসলাম আমার ধর্ম, মুসলিম আমার পরিচয়।’ কবি বলেন, তাঁর ভয় বা শঙ্কার কিছু নেই কারণ কুরআন তাঁর ঘোষণা বা অস্ত্রস্বরূপ। তিনি সাহসের সাথে তাঁর ধর্মীয় পরিচয় ঘোষণা করছেন—ইসলাম তাঁর ধর্ম, আর তিনি গর্বিত মুসলিম।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সাহিত্যকর্মে হামদ রচনা করেছেন অনেক, যা তাঁর ধর্মীয় অনুভূতি ও গভীর ইসলামী চেতনার স্পষ্ট প্রতিফলন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য হামদ হলো— ‘রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার’; ‘বিচার চাহিনা তোমার দয়া চাহি এ গুনাহগার’; ‘শোনো শোনো ইয়া এলাহী’; ‘খোদার প্রেমের শরাব’;  ‘খোদা এই গরীবের’; খোদার আরশ ছুঁয়ে কথা কইছে রে কোরআন’; ‘ওরে ও মুসলিম ভাই, খোদার প্রেমে পাগল হ’; ‘লা শরীক আল্লাহু লা শরীক’; ‘আল্লাহ তায়ালার নাম শুধু মুখে বলো রে ভাই’; ‘তাহার নাম যপে রে মন, যপে তাহার নাম’; ‘আল্লার সাথে মিলন হবে রে এই রোজারই শেষে’; ‘রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’; ‘আল্লাহ, আমি তোরই রসুলের উম্মত’; ‘নামাজ আমার মেরাজ রে ভাই, আল্লার সঙ্গি হই’; ‘আমি সেই দিনের কথা বলি’; ‘আল্লা তুমি মহান, তুমি দয়াময়’; ‘আসমানে চাঁদ তারা ঝিকিমিকি করে—আল্লাহু আল্লাহু ধ্বনি উঠে রে’; ‘তুমি আল্লাহু তুমি করিম, তুমি রহমান রাহিম’; ‘হে খোদা, তোর দয়ার সাগর—দয়া কর মোরে’ ও ‘আল্লাহু আল্লাহু করে রে মন’ ইত্যাদি। এই হামদগুলোতে আল্লাহর প্রতি প্রেম ও ভক্তির প্রকাশ ঘটেছে। এর বাইরে কাজী নজরুল ইসলামের অন্যান্য ইসলামী গীতিকাব্য ও সংগীত রচনাগুলোর মধ্যেও তার ধর্মীয় অনুভূতি ও চেতনার প্রতিফলন পাওয়া যায়। 
কাজী নজরুল ইসলামের না’তগুলোতে নবীর চরিত্র, দয়া, সাহস, নেতৃত্ব, ও মানবতার প্রতি ভালোবাসা তুলে ধরা হয়েছে গভীর আবেগ ও অনুরাগে। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি প্রেমকে শুধু ধর্মীয় অনুশীলন হিসেবে নয়, বরং মানবিক আদর্শের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন—

মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে।
তাই কি রে তোর কণ্ঠের গান এমন মধুর লাগে ॥
... ... ... ... ... ... ... ... 
... ... ... ... ... ... ... ... 
ওরে ভ্রমর, তুই কি প্রথম
চুমেছিলি নবির কদম,
আজও গুনগুনিয়ে সেই খুশি জানাস রে গুলবাগে।”
[মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে, বনগীতিকা, ২য় সংস্করণ, ১৯৫২]

এই গজলে কাজী নজরুল ইসলাম প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর (পাখি, ফুল, চাঁদ, ভ্রমর ইত্যাদি) মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন, প্রকৃতিও যেন রাসূল মোহাম্মদ (স.)-এর প্রতি প্রেমে মাতোয়ারা ছিল। কবি মনে করেন, শুধু মানুষ নয়, প্রকৃতির প্রতিটি সত্তাও রাসূলের সৌন্দর্য ও পবিত্রতায় বিমোহিত হয়ে গিয়েছিল।
এখানে ‘বুলবুলি’ (এক ধরনের গানের পাখি) প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কবি বলছেন, হয়তো এই বুলবুলি নবী মোহাম্মদের নাম বহু আগেই জপ করেছিল, তাই তার কণ্ঠে এত মধুরতা। তার সুর এত আকর্ষণীয়, এত হৃদয়গ্রাহী—কারণ সে সুরের মধ্যে নবীর নামের গুণ ছিল। এটিকে একধরনের আধ্যাত্মিক রূপক বলা যায়—যেখানে কবি বলছেন, যে হৃদয়ে নবীর ভালোবাসা আছে, তার প্রকাশও হবে পবিত্র ও মধুর। কবি ভ্রমরকে (মৌমাছি জাতীয় একটি পতঙ্গ) সম্বোধন করে বলছেন, তুই কি নবীর পা প্রথম চুম্বন করেছিলি? আজও কি সেই সুখস্মৃতি গুনগুন করে জানাস ফুলবাগানে? এখানে ভ্রমরের গুনগুন শব্দকে প্রেমের প্রকাশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। নবীর প্রতি ভালোবাসা এমন এক অভিজ্ঞতা, যার স্মৃতি চিরকাল আনন্দ দিয়ে যায়। ভক্তি ও প্রেমে পূর্ণ কবিতা জুড়ে রয়েছে নবীর প্রতি এক নিবিড় ভালোবাসা, যা শুধু মানুষের হৃদয়ে নয়, প্রকৃতির মধ্যেও ছড়িয়ে গেছে। এখানে বুলবুলি, গোলাপ, চাঁদ, ভ্রমর—এগুলো সবই রূপক। এগুলো স্রষ্টার প্রেমে মগ্ন সৃষ্টির প্রতীক। কবি প্রকৃতি ও নবীর মধ্যে এক আধ্যাত্মিক বন্ধন কল্পনা করেছেন, যা ঈমানদার পাঠকের হৃদয়ে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
কবির ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ’ কবিতাটি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও বিশ্বজনীন শান্তির বার্তা বহন করে। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গজলে নবীর জীবনের রূপকথার মতো সুন্দরের সঙ্গে মানবতা, ন্যায় ও করুণার আদর্শ তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন—

ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়।
আয় রে সাগর আকাশ বাতাস দেখ্বি যদি আয়।
... ... ... ... ... ... ... ... 
... ... ... ... ... ... ... ... 
“নিখিল দরুদ পড়ে লয়ে নাম, সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম।
জীন পরী ফেরেশ্তা সালাম জানায় নবীর পায়।
[নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, একত্রিশতম খণ্ড, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭]

এখানে নবী মুহাম্মদের আগমনকে বিশ্বজগতের জন্য এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত বলা হয়েছে। তাঁর আগমন সাগর, আকাশ, বাতাস—সবকিছুই মুগ্ধ হয়। অর্থাৎ, গোটা প্রকৃতি তাঁর আবির্ভাব উপলক্ষে আনন্দিত। পৃথিবীর ধূলোময় মাটিকে (ধূলির ধরা) স্বর্গের মতো সুন্দর করে তুলেছেন নবী। তাঁর আগমন মানুষের হৃদয়ে লজ্জা (অনুতাপ) দূর করে আনন্দ এবং আশা এনে দিয়েছে। ধূসর সাহারা (বন্য ও নির্জন মরুভূমি) এখন খুশির নদীতে পরিণত হয়েছে। নবীর শৈশবের কথা বলা হয়েছে। আমিনা তাঁর মা, আর নবী শিশু যখন দোলায় দোলায় ‘ইসলাম’ (পৃথিবীর শান্তির ধর্ম) শিখছে, যা তার কচি মুখ থেকেই স্বাভাবিক ও অনুপ্রাণিত। নবীর আগমনের ফলে পাপীরা ক্ষমা পেয়েছে। দুনিয়ায় অবিচার ও অত্যাচার কমে গেছে। অর্থাৎ, তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ করলে সমাজে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববাসী নবীর প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠায়। মানুষ, জীন, পরী ও ফেরেশ্তারা নবীকে সালাম পাঠান। এর মাধ্যমে নবীর সর্বজনীন মর্যাদা ও সম্মান ফুটে ওঠে।

কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামী গানগুলোতে আরবি-ফারসি শব্দের মোহনীয় ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তিনি ইসলামী সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতাকে গান ও কবিতার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি ধর্মীয় গানের মধ্যে ইসলামী ভাবধারায় রচিত ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসায় নিবেদিত অসংখ্য ‘না’ত রসূল’ রচনা করেছেন। ‘নাম তার আহমদ, মহামদ, মোহাম্মদ’; ‘ইসলামের ঐ রাহবারগো, মোহাম্মদ মোস্তফা’; ‘ওই নামাজের কলি শুনে উঠলো রে মন’; ‘মদিনার গলি সে যে আমার স্বপ্নে আসে’; ‘তোর রূপের খোদা খোদা করে’; ‘মোদের খোদার রসুল মোহাম্মদ’; ‘পথ ছিল আঁধারে ধরা, দিলে তুমি দিশা’; ‘পাগল করিলে মোহাম্মদ রে তোর প্রেমেরই বান’; ‘তুমি যে আমার কবি, আমি যে তোমার গান’; ‘নবী মোহাম্মদ রসুলে খোদা’; ‘আমি গাই — তাহারি গান’; ‘নাম মোহাম্মদ বুলবুলি সম’; ‘যেদিন প্রথম মোহাম্মদের রওজা দেখিলাম’; ‘নবী নামের নূর বহে দুনিয়ার আঁধাওে’; ‘মোহাম্মদ মোস্তফা, তুমি জাহানের দরুদ’; ‘আল্লার রাসুল মোহাম্মদ এসেছে রে দুনিয়ায়’; ‘নাম তার মোহাম্মদ—বোল রে মন বোল’; ‘আল্লাহ্ গো, নবী আমার নাম ধরে ডাকেনা কেন’; ‘জেগে উঠরে মুসলমান, তুই আজ মোহাম্মদের জাত’; ‘মোস্তফার নাম জপরে মন, মোস্তফার নাম জপ’; ‘খোদার প্রেমের শিখা, দগ্ধ করেছে আমায়’; ‘নবী আমার রাসুল আমার, মোহাম্মদ মোর প্রিয়তম’; ‘বেহেশতে চল রে মন, মোস্তফার দলে’; ‘কাঁদে আজ মদিনা, কাঁদে আরব জমিন’; ‘ওরে নবীর প্রেমে গাওয়া গান, খোদার কুদরত জান’; ‘আলি-হাসান-হুসাইন নবীর ঘরানা’; ‘মদিনার পথে চলে কে রে’; ‘আমার নবী পেরেশান, কাঁদে উম্মতের জন্য’; ‘মোহাম্মদের প্রেমে পাগল আমি’ ও ‘রসুলের রওজা দেখেছি স্বপনে’ ইত্যাদি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত বিখ্যাত না’ত।

কাজী নজরুল ইসলামের হামদ-না’ত ও ইসলামী চেতনাবোধ আশ্রিত কবিতাগুলো বাংলা সাহিত্যে এক নবদিগন্তের সূচনা করেছে। তিনি ইসলামী ভাবধারাকে শুধু ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সাহিত্যের উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। কাজী নজরুল তাঁর হামদ ও না’তে সাহিত্যিক শৈলী ও সংগীতের অপূর্ব মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তার আরবি-ফারসি শব্দের সুষ্ঠু ব্যবহার বাংলা ইসলামী সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছে। এ হামদ ও না’তগুলো শুধু মুসলিম সমাজকেই নয়, বরং সমগ্র মানবজাতিকে নৈতিকতা, মানবতা ও শান্তির পথে আহ্বান জানায়। এই সকল রচনা আজও বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের হৃদয়ে এক গভীর শ্রদ্ধা ও আবেগের স্থান দখল করে আছে।
লেখক : muhammadeliasnk&gmail.com

 

আরও পড়ুন