ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

ধারাবাহিক

রাস্তার মাস্টার ॥ শারমিন রহমান

আপডেট : ২২ আগস্ট ২০২৫, ০২:৫৭ পিএম

পর্ব-০১ 
আভা ঘোমটার আড়াল থেকে ডাগর ডাগর চোখে বাড়িটা দেখে নেওয়ার চেষ্টা করছে। পেটের ভেতরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ। প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে। বিয়ে বাড়িতে তার খাবার নিয়ে কারো কোন ভাবনা নেই। নতুন বউ হিসেবে আভা কাউকে বলতে পারছেনা খাবারের কথা। তখনো তাকে বরন করে নেবার কিছু কাজ বাকি। আভার মনে হলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।এখনি তার কিছু খেতে হবে খাবারের কথা ভাবতেই তার চোখ ফেটে জল এলো। পৃথিবীতে কি একমাত্র আভারই এতো ক্ষুধা লাগে!! এই ক্ষুধার কাছে অসহায় আভা। বাবা রমানাথ মুখার্জি কাজ করতো রেল রাস্তায়।গরীব হলেও আভার খাবারের কোন অভাব বুঝতে দেয়নি বাবা। কিন্তু বাবা রেলে কাটা পড়লো। যেন বাবা সাথে করে নিয়ে গেলো  পৃথিবীর সকল আনন্দ, ভালোবাসা, স্বচ্ছলতা।  আর আভার জন্য রেখে গেলো এক পৃথিবী ক্ষুধা আর অভাব। খেতে না পেয়ে আভার শরীর এতোই শুকিয়ে গেল যে মুখের  সামনের  দাঁত ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়তোনা প্রথম দর্শনে। তার মায়াভরা চোখে শুধু ক্ষুধা ভেসে উঠলো।
দাদা আভার বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে শুরু করলো। শরীরে লাবন্যতা না থাকলে কিছু  মানুষরূপী কুকুরের কাছে নারী শরীর ক্ষুধা নিবারনের বস্তুু।তাতে লাবন্যতা বা মমতার প্রয়োজন নেই। আভার দাদার শুধু মনে হতে লাগলো রাস্তার ভবঘুরে কুকুরগুলোর হাত থেকে বোনকে বাঁচানোর জন্য একটা পাত্র প্রয়োজন। যে আভাকে দুবেলা দুমুঠো খাবার আর মাথার উপর একটা নিরাপদ ছাদের নিশ্চয়তা দিতে পারবে। 

১১ বছরের কিশোরীর জন্য পাত্র খোঁজা শুরু হলো। কিন্তু না আছে আভার শরীরের লাবণ্যতা, না আছে যৌবন। পুরো শরীরে শুধুই অভাবের চিহ্ন, ভাতের অভাব। অবশেষে, ১৪ বছর বয়সে আভার জন্য এক পাত্র পাওয়া গেলো। নন্দী গ্রামের সত্য নারায়ন নায়কের সাথে বিয়ে হলো আভার। আভার দাদা খুব খুশি হলো। সত্য নারায়নের পূর্ব পুরুষ জমিদার ছিলো। এখন সেই জমিদারী না থাকলেও নামডাক আছে বেশ ভালো। বাড়িতে পুরনো আমলের  দালান, পুকুর দেখে আস্বস্ত হয়ে বিয়ের দিন ঠিক করে দিলো আভার দাদা। আভা বিয়ে কি না বুঝলেও এতটুকু জেনেছে তার তিনবেলা পেট ভরে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। আভা এই ভেবে ভীষণ খুশি যে তার জীবন থেকে অভাব চিরতরে বিদায় নিলো। 

এসব ভাবতে ভাবতেই আভার পেটের মধ্যে ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো আবার। একটি মেয়ে এসে দুটো মিষ্টি আর তিনখানা নোনতা বিস্কিট দিয়ে গেলো বিশাল বড় এক প্লেটে করে। বড়ো প্লেটের মধ্যে মিষ্টিটাকে একটি বিন্দুর মতো মনে হলে আভার। আভা মিষ্টিটা ছো মেরে নিয়েই মুখে পুরে নিলো। বিস্কিট ধরার আগেই বাচ্চারা কাড়াকাড়ি করে খেয়ে ফেললো। একটি ছেলে হা করে তাকিয়ে আভার মুখের মিষ্টি খাওয়া দেখছে। তার ধারনা ছিলে নতুন বউ হাত দিয়ে কিছু খাবেনা। তাইতো মায়ের কাছে গল্প শুনেছে।  নতুন বউকে মিষ্টি খাওয়ানোর নাম করে সে খানিকটা খেয়ে নেবে, এই আশায় বসে ছিলো এতক্ষণ।  কিন্তু নতুন বউয়ের মিষ্টি ছো মেরে খেয়ে নিতে দেখে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। আভা খেয়াল করলো বিষয়টা। ওর দেখে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিলো। একগ্লাস জল খেয়ে পেটটাকে আপাতত স্বান্তনা দিতে পারলো আভা। যে অভাব থেকে বাঁচার জন্য এই বিয়েতে এতো খুশি ছিলো আভা,  সে জানতেও পারলো না যে তার জীবন গল্পে অভাব আর সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার পরিকল্পনা ভাগ্য বিধাতা তার জন্য  করে রেখেছেন বহু আগেই।

সত্য নারায়ন মানুষ হিসেবে ভীষণ ভালো।কিন্তু বড্ড নরম স্বভাবের আর ভিতু মানুষ। আভা বিয়ের আগে কল্পনা করতো কেমন হবে জমিদারের বাড়ি। ভেবে আর কুল পেতোনা আভা। ওর মনে হতো পূর্বপুরুষ জমিদার মানে গোলাভরা ধান,পুকুরভরা মাছ, চারপাশে চাকর-চাকরানী,  আরাম আর সুখের জীবন। এসব শুনে সত্য নারায়ন হেসেছিলো। আভাকে বুঝিয়েছিলো। জমিদারতো পূর্বপুরুষ ছিলো।সেই কবেকার গল্প সেসব। আমাদের তো পরের জমিতে খেটে খাওয়া জীবন। সত্য নারায়নের তার সহজ সরল কিশোরী বউটার জন্য মায়া হতো। কতোইনা আশা নিয়ে এসেছে এই বাড়িতে। কী ই বা দিতে পারবে মেয়েটাকে! 

কল্পনার মতো না হলেও আভার এই বাড়িটা বেশ ভালো লাগে। দুপাশে মেঠো পথ, সামনের দিকে স্নানের জন্য পুকুর। গাছপালা ঘেরা বাড়িটাতে বেশ মায়া ছড়ানো। পুরনো বিল্ডিংটাতে মোট ৬ খানা ঘর। সামনে বড় খোলা বারান্দা। পুজোর আসন রয়েছে তার এক কোনে। সামনে বাঁধানো তুলশি মঞ্চ। ঘরটাতে রং নেই কোন। তবুও পোড়া ইটের পোড়া খয়েরি রং টা ভালো লাগে আভার। কোথাও কোথাও ইট সুরকি ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছে। 

আরও পড়ুন