।। ৬।।
তবে ভেতরে ওঠার খুব ইচ্ছে সোনালীর। রেলগাড়ি চিকন পথের ওপর কীভাবে এঁকেবেঁকে চলে এটা একটা বিস্ময় ওর কাছে। সত্য নারায়ণ পেছনে তাকিয়ে দেখে মেয়ে চলে যাওয়া রেলগাড়ির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা রেলগাড়ি দেখলেই কেমন যেন হয়ে যায়। ওকে একদিন রেলগাড়িতে চড়াতে হবে, নিজেকেই যেন কথা দিলো সত্য নারায়ণ। বাবার ডাক শুনে দৌড়ে পৌঁছে গেলো সোনালী। সবাই মিলে হাত ধরাধরি করে হাটের মধ্যে ঢুকলো ওরা।
মাটির বাঁশি, পাখি, ঢোল, কথা বলা পুতুল, নানা রঙের চুড়ি, গলার মালা কী নেই হাটে! মেয়েরা ঘুরে ঘুরে দেখছে। কখনো কখনো হাত দিয়ে ধরে দেখছে। কিন্তু বাবার কাছে কারো আবদার নেই। বেশ বড় একটা মাছ কিনেছে সত্য নারায়ণ আজকে। ফুলকাকুর মাসে মাসে যে পয়সা পাঠায় তার টাকাটা গতকালই হাতে পেয়েছে। মেয়েদের শুধু ঘুরতে নিয়ে আসে সত্য নারায়ণ। কখনো কিছু কিনে দেয় না এখান থেকে। আজ মনটা কেমন হুহু করে উঠলো। মেয়েরা পুতল, বাঁশি ধরে দেখে, দাম জিজ্ঞেস করে। দাম শুনে রেখে দেয় আবার। সত্য নারায়ণ মেয়েদের রেখে ফিরে যায় আবার মাছ বাজারে। বাজারের ব্যাগ থেকে মাছটা বের করে ফিরিয়ে দেয় মাছওয়ালাকে। মাছ ফিরিয়ে পয়সাটা ফেরত নিয়ে নেয়। মাছওয়ালার কাছে দুটো কটু কথা শুনতে আপত্তি নেই। কিন্তু মেয়েদের আজ হাসতে দেখতে চায় সত্য নারায়ণ। তিনজনকেই পছন্দের ঢোল, বাঁশি কিনে দেয়। পছন্দের বাঁশি, ঢোল হাতে পেয়ে খুশিতে লাফাতে থাকে ৩ মেয়ে। সত্য নারায়ন চোখের জল আর ধরে রাখতে পারে না। আড়াল করে মুছে নেয় সে জল। আজ বড্ড ইচ্ছে করছে আভার জন্য কিছু নিতে। সত্য নারায়ণ আভার জন্য একটা সুগন্ধি তেল কিনে লুকিয়ে রাখে বাজারের ব্যাগে। এরপর চাঁদের আলোয় মেয়েদের সঙ্গে করে বাড়ির পথ ধরে সত্য নারায়ণ।
প্রায় তিন বছর হয়ে গেলো ফুল কাকুর বাড়িতে আভাদের আসার। শরৎ এর আকাশে ভেসে বেড়ানো শুভ্র মেঘের মতো হাসিখুশিতে কেটে যাচ্ছে দিন। জীবনের বিভৎস দিনগুলোয় ধুলো জমতে শুরু করেছে। এরমধ্যে ফুলকাকু ১-২ বার এসে ঘুরে গেছেন। আভার হাতের রান্না খেয়ে ভীষণ খুশি ফুলকাকু। মেয়েদের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি না হলেও ফুলকাকু খোঁজ নিতেন ওদের। খাবার শুরু করেই বলতেন, ‘বৌমা, তোমার মেয়েদের খেতে দাও এবার। বেলা যে অনেক হলো।’ মেয়েরা প্রথম দিকে দাদুর কাছাকাছি যেতে চাইলেও আভা সচেতনভাবে দূরে রাখার চেষ্টা করতো ওদের। গম্ভীর মানুষ বাচ্চাদের আচরণে বিরক্ত হতে পারে ভেবেই এটা করেছে আভা। মেয়েরাও ফুলকাকুর রাশভারী চেহারা আর ব্যক্তিত্ব দেখে পরবর্তীতে দূরেই সরে থেকেছে।
ফুলকাকুর জঙ্গল হয়ে যাওয়া বাড়িটি পরিষ্কার করতে যখন এসেছিল ওরা তখন ২ টা কুকুরের বাস ছিল বাড়িটিতে। যেন ওরাই পাহারাদার। নতুন মানুষ দেখে খুব বিরক্ত হয়েছিল। মেয়েরাও প্রথম প্রথম ভয় পেতো। কিন্তু এখন খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে ওরা। নাম রেখেছে বুলু আর ভুলু। সোনালী আর কাবেরী যখন স্কুলে যায় তখন পেছন পেছন বুলু, ভুলু স্কুলে যায়। ওদের স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। যেন নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। আভার রান্নাঘরের সামনে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে সারাদিন। ওদের স্কুল ছুটির ঠিক আগ মুহূর্তে বুলু, ভুলু বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। ওদের নিয়ে ফেরে। সোনালী আর কাবেরীর কাছে শুনেছে স্কুলের সামনে বটগাছের নিচেই ওরা দাঁড়িয়ে থাকে। আভা আর সত্য নারায়ন অবাক হয়। কী করে ওরা বোঝে স্কুল ছুটির সময় হয়েছে। এ বিষয়টা রহস্যই রয়ে গেছে ওদের কাছে। কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারে না আভা আর সত্য নারায়ন। ওরা এর অর্থ না বুঝলেও এটুকু বুঝেছে - অনেক মানুষ থেকে কুকুর বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে উঠতে পারে।
বসন্তের চমৎকার দিনগুলোয় আভা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো। বিছানা থেকে মাথা তুলতে পারছে না। ডাক্তার ডাকার পর আভার অন্তঃসত্ত্বার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলো। আভা এবং সত্য নারায়ন দুজন দুজনের দিকে নিরবে তাকিয়ে রইলো শুধু। এক অজানা ভয় ছিল সে দৃষ্টিতে। এবার কি তাদের ভাগ্যে একটা ছেলে সন্তান আসতে চলেছে। নাকি আরেকটা মেয়ে আসবে পৃথিবীতে!
চলবে...
