শরৎকালের কাশবন তিথিকে খুব টানে। তাদের ঘরের দক্ষিণের বারান্দায় এলে বাড়ির পাশে অতি কাছের খালপাড়ের কাশবন দেখা যায়। এই শরতে সেই খালপাড়ের কাশবনে সাদা সাদা কাশফুল ফোটে সীমানাটা ভারী সুন্দর হয়ে উঠেছে। তিথি তাদের বারান্দায় এসে ওই কাশবনে বাতাসে কাশফুলের দোল খাওয়া দেখছে। তার খুব ইচ্ছে হলো এখনই ওখানে যাবে৷ যে ভাবা, সেই কাজ।
তিথি কাশবনে যাওয়ার উদ্দেশে ঘর থেকে বের হতেই হঠাৎ মনে হলো বড় আপার আইফোনটা নিয়ে যাবে। সেখানে নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলবে৷ কিন্তু বড় আপা যে তার আইফোনটা দেবে না, তিথি এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত। বড় আপা আজকাল তার আইফোন কাউকে ধরতে দেয় না৷ কে যেন তাকে হুটহাট ফোন করলেই সে দৌড়ে ছাদে চলে গিয়ে সিঁড়ি ঘরের দরজা আটকে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একনাগাড়ে কথা বলে আর ক্ষণে-ক্ষণে খিলখিলিয়ে হাসে। জানতে চাইলেও সঠিক জবাব দিতে চায় না৷ আর তার আইফোনটার নাগাল তো কেউ-ই পায় না।
টি-টেবিলের ওপর বড় আপার আইফোনটা দেখা যাচ্ছে। তিথি সুযোগ পেয়ে এদিক-সেদিক তাকায়। না, বড় আপাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সেই সুযোগে তিথি আইফোনটা নিয়ে সোজা চলে আসে বাড়ির পাশের কাশবনে। ক্যামেরাটা অন করে কাশফুল ধরে ধরে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিমায় বেশ কয়েকটা ছবি তুললো। এরই মধ্যে একটি ফোন এলো আইফোনে। 'রাসেল' নামে সেইভ করা নাম্বারটি। কে এই রাসেল! রাসেল নামে তাদের কোনো আত্মীয় আছে বলে তিথির মনে পড়ে না। ছোট খালার এক ননদের ছেলে আছে রাসেল নামে। কিন্তু সে রাসেলের কল আসার তো কথা নয়। সে রাসেল অনেক বছর আগেই পানিতে ডুবে মারা গেছে। মৃগী রোগ ছিল। তাহলে বড় আপার কাছে আসা এই কল কোন রাসেলের!
এসব ভাবতে ভাবতে ততক্ষণে কলটি কেটে গেলো। তিথি আরও কয়েকটা ছবি তুলে নিল৷ হঠাৎ বড় আপা উল্কার মতো উড়ে এসে তিথির হাত থেকে তার আইফোনটি ছিনিয়ে নেয়। তুই কার অনুমতি নিয়ে আমার আইফোন ধরেছিস? আমি বারান্দায় এসে দেখছিলাম তুই কাশবনে আমার আইফোন এনে ছবি তুলছিস।
-হ্যাঁ, তুলেছি। তাতে কী! আমি তো আর তোর আইফোনটা খেয়ে ফেলিনি।
-তর্ক করিস না তিথি। আমার কোনো মেসেজ পড়েছিস?
-না।
-সত্যি?
-হুঁ।
-যদি কোনোভাবেই জানতে পারি তুই আমার কোনো মেসেজ পড়েছিস, কাঁচা খেয়ে ফেলবো। মনে রাখিস।
-মেসেজ পড়িনি তো। এত প্যাচাচ্ছিস কেন আপা? স্বাভাবিক থাক।
-যা বাড়ি যা। যা বলছি।
তিথি কথা বাড়ায় না। চুপচাপ বাড়ির দিকে যেতে যেতে বলে, ‘বেশ কয়েকটা ছবি তুলেছি আপা, ডিলিট করিস না।’ তিথি চলে যাওয়ার পর তিন্নি রাসেলকে ভিডিও কল দেয়।
-কি গো আমার টুনটুনি! কল দিয়েছি। ধরোনি কেন?
-মোবাইল আমার কাছে ছিল না যে।
-তুমি কোথায় আছ? বাইরে মনে হচ্ছে!
-হুঁ৷ কাশবনে এসেছি। দেখো, সাদা-সাদা কাশফুলে সব শুভ্র হয়ে গেছে।
তিন্নি ভিডিও কলে রাসেলকে কাশবন ঘুরে ঘুরে দেখায়। সুইডেন প্রবাসী রাসেল ভিডিও কলের এপারে কাশবন দেখে নস্টালজিক হয়। দেশে থাকাকালে প্রতি শরতে রাসেল তাদের বাড়ির ধারের কাশবনে মধুর সময় কাটাতো। তার ফেসবুকে সে-সব ছবি এখনো আছে।
রোদে পুড়ছে তিন্নি। মাথার ওপর গনগনে রোদে বড় অস্থির লাগছে।
-আমি এখান থেকে যাচ্ছি রাসেল। রোদে ভালো লাগছে না।
-না যেও না। আরও কিছুক্ষণ থাকো। কতবছর বাংলাদেশের শরৎ দেখি না৷ যাওয়া হয় না কাশবনেও। আহারে আমার পুরাতন অতীত।
-কবি কবি কথা রাখো। আমি গেলাম। রোদে জ্বলে কালো হয়ে যেতে চাই না।
-যেও না প্রিয়। এত যাই যাই বলো কেন? মন চায় গাঙচিলের মতো উড়ে এসে তোমার সঙ্গে এই কাশবনে মধু অভিসার করি।
-তা আর করতে হবে না। আমি গেলাম।
-আচ্ছা যাও। তোমার বাবা-মাকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলেছ?
-না বলিনি। ডর করে।
তিন্নির কথা শুনে ভিডিও কলের ওপারে রাসেল অট্টহাসিতে মেতে ওঠে। তিন্নি বাড়ির দিকে যখন পা বাড়ালো, তখনই শরতের এক চিলতে লিলুয়া বাতাস এসে কাশবন যেন শীতল করে দিলো।
