যথাযথ মর্যাদায় আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হয়েছে শনিবার (৮ মার্চ)। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে সমাজ ও পরিবারে নারীর কৃতিত্বকে স্মরণ ও সম্মান জানাতে প্রতিবছর এই দিনটি পালন করা হয়। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
বাংলাদেশেও সরকারি, বেসরকারি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংগঠন ও সংস্থা দিবসটি পালনে যথাযথ কর্মসূচি পালন করেছে। এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন’। এ উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বাণীও দিয়েছেন।
বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষায় ছাত্র-শ্রমিক-জনতা যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছিল গত জুলাই-আগস্টে, তার সম্মুখ সারিতে ছিল নারী। লাখ লাখ ছাত্রী বিভিন্ন ক্যাম্পাসে দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়েছে। একাধিক নারী এই গণ-অভ্যুত্থানে শাহাদাতবরণ করেছেন।

এদিকে কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন না হওয়ায় নারী নির্যাতনের ঘটনা কমেনি বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। গত দুই মাসে (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) ২৯৪ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৬৩ এবং এর মধ্যে ৪৪ জন শিশু রয়েছে।
দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩১ জন নারী এর মধ্যে ১৪ জন রয়েছে শিশু। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ নারী (ধর্ষণের সংখ্যা ২১ টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের সংখ্যা ১৮ টি) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এর ওয়েবসাইট ও আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ইউএনএফপিএ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবনের কোন না কোন সময় শারীরিক, যৌন নির্যাতনসহ যেকোন নির্যাতনের শিকার হন। জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে যে ধরনের ফোন আসে, সেই তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নারীর প্রতি হয়রানি, নিপীড়ন, আর সহিংসতার অভিযোগ জানাতে বা সাহায্য চেয়ে ফোন কলের সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিল্স এর সংবাদপত্র ভিত্তিক জরিপ অনুযায়ী ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৭০ জন নারী শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে কর্মস্থলে ২৫ জন এবং কর্মস্থলের বাহিরে ৪৫ জন নারী শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নারীরা যে কোথাও নিরাপদ নয় তা এসব ঘটনা আবারো প্রমাণ করেছে। নারী এবং নিরাপত্তা শব্দ দুটি যেন আমাদের সমাজে ক্রমশ বিপরীতমুখী শব্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চলেছে।
ঘরে-বাইরে, পরিবারে, লোকালয়ে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, গণপরিবহণে এমনকি লাশকাটা ঘরে মৃত নারীও নিরাপদ নন। নারীর নিরাপত্তা এখন বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন।
এই নিরাপত্তাহীনতার অবসান কিভাবে ঘটবে সেটাই এখন মূল প্রশ্ন? জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ মনে করে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনেরও যথাযথ প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। শুধু আইন দিয়েই আমরা আমাদের সমাজে নারীদের প্রতি করা অমানবিক আচরণ বন্ধ করতে পারব না। এজন্য আমাদের মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তনও অত্যন্ত জরুরি।
নারীর প্রতি হয়রানি ও নির্যাতন রোধে শনিবার( ৮ মার্চ) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ আয়োজিত মানববন্ধন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তরা নারী নির্যাতন বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও ধর্ষণকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। তারা বলেছেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২৫ উপলক্ষে ‘কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন সংক্রান্ত হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন এবং আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুসমর্থনের দাবী জানান।
মানববন্ধন কর্মসূচী অনুষ্ঠানে জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ এর সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কর্মজীবী নারীর নির্বাহী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) সানজিদা আক্তার, আওয়াজ ফাউন্ডেশন এর সভাপতি মমতাজ বেগম, বিলস পরিচালক নাজমা ইয়াসমীন, ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশন কাণ্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ বাবলুর রহমান, সবুজের অভিযান ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক মাহমুদা বেগম, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নিগার সুলতানা। মানববন্ধন সঞ্চালনা করেন আওয়াজ ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার। এ সময় জেন্ডার ফ্লাটফর্ম এর অর্ন্তভুক্ত সংগঠনের প্রতিনিধিসহ এলাকা থেকে আগত শ্রমিক ও নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বক্তারা বলেন, ধর্ষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা, বিচারের আওতায় আনা, হত্যা-গুম এর বিরুদ্ধে আজয়াজ তুলতে হবে। এ ছাড়া নারী নির্যাতন বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও ধর্ষণকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তারা। নারীর কর্মের মজুরি বৈষম্য,সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, আইএলও কনভেনশন ১৯০ /১৮৯ অনুসমর্থন এবং সর্বক্ষেত্রে মাতৃত্বকাকীন ছুটি ৬ মাস করারও জোর দাবী জানান তারা। মানববন্ধন কর্মসূচী শেষে একটি র্যালি বেড় করা হয়। র্যালিটি প্রেসক্লাব এলাকা প্রদক্ষিণ করে।
মাগুরায় ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী শিশুটির অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। তার চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। গতকাল দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শিশুটির শারীরিক অবস্থার তথ্য জানাতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
ঢামেক পরিচালক বলেন, শিশুটির অবস্থা ভেরি ক্রিটিক্যাল। তার গলার আঘাত খুবই মারাত্মক। তার যৌনাঙ্গেও আঘাত রয়েছে। গত রাত ৯টার দিকে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকরা আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।
শিশুটির চিকিৎসার জন্য পেডিয়াট্রিক, পেডিয়াট্রিক সার্জারি, অ্যানেসথেসিয়া ও গাইনি ডিপার্টমেন্ট মিলে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। রমজানে স্কুলের ছুটিতে মাগুরা শহরে বড় বোনের (শ্বশুর) বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল তৃতীয় শ্রেণির ওই শিশুটি। তার মা জানান, বাড়িতে একা পেয়ে কেউ শিশুটিকে ধর্ষণ করেছে।
পুলিশ শিশুটির বোনের স্বামী ও শ্বশুরকে আটক করেছে। গত বৃহস্পতিবার সকালে বোনের শাশুড়ি শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে প্রতিবেশীরা তার বাবা-মাকে বিষয়টি জানায়।
সেসময় মাগুরা সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, তাৎক্ষণিক পরীক্ষা করে দেখা গেছে, শিশুটির গলায় একটা দাগ আছে। মনে হচ্ছে, কিছু দিয়ে চেপে ধরা হয়েছিল। শরীরের বেশ কিছু জায়গায় আঁচড় আছে। তার যৌনাঙ্গে রক্তক্ষরণ হয়েছে।
মাগুরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আইয়ুব আলী জানান, পুলিশ ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছে।
মাগুরার নির্যাতিত সেই শিশুর মায়ের সঙ্গে ফোনকলে কথা বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ সময় ওই শিশুর বর্তমান পরিস্থিতির খোঁজখবর নেন এবং সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি। শনিবার ওই শিশুর মায়ের সঙ্গে কথা বলে শিশুটির শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেন তিনি। এ সময় শিশুটির মাকে ন্যায়বিচার পেতে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।
ফোনালাপে তারেক রহমান বলেন, মাগুরায় বিএনপির যত নেতাকর্মী আছেন, তারা সবাই ওই শিশুর পাশে থাকবেন। ন্যায়বিচার পাওয়ার আশ্বাস দিয়ে তারেক রহমান বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করব। শিশুটির সঙ্গে যারা অন্যায় করেছে তারা যেন আইন অনুযায়ী শাস্তি পায়।
এ সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন, শিশুটির চিকিৎসার জন্য যা প্রয়োজন আমরা চেষ্টা করব, আমাদের দলের অবস্থান থেকে। শিশুটির মা তার মেয়ের ওপর পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরেন তারেক রহমানের কাছে। এটা শুনে তিনি আবারও বলেন, আমরা আমাদের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব শিশুটি যাতে ন্যায়বিচার পায়। পরে দলের নেতারা সবসময় তার পাশে থাকবেন বলে আবারও আশ্বস্ত করেন তারেক রহমান। সবশেষে তিনি শিশুটির দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন।
আট বছরের ওই শিশুকে হত্যাচেষ্টা ও ধর্ষণের অভিযোগে শনিবার মাগুরা সদর থানায় চারজনের নামে মামলা হয়েছে। মামলাটি দায়ের করেছেন ওই শিশুর মা।
মামলায় আসামি করা হয়েছে শিশুর বোনের স্বামী সজিব শেখ (১৯), সজিব শেখের ছোট ভাই রাতুল শেখ (১৭) ও সজিবের মা জাহেদা বেগম (৪০), বাবা হিটু শেখকে (৪৭)। এরা চারজনই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিরাজুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনার তদন্ত ও সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া চলমান আছে। মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে মামলার আসামিদের আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে শিশুটির মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের এজাহারভুক্ত করা হয়েছে।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শিশুটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শুক্রবার (৭ মার্চ) রাত থেকে লাইভ সাপোর্টে রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। বুধবার (৫ মার্চ) রাতে মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ালী এলাকায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার শিকার হয় শিশুটি।
