ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

ব্যাটারিচালিত রিকশা : প্রাণঘাতী বাহন বন্ধ হবে কবে ॥ জান্নাতুল যূথী

আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০২ এএম

দেশের সড়কগুলো এক একটি মৃত্যুফাঁদ! সেখানে সহযোগী হিসেবে রয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা! বলা হয়, ‘একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না।’ কিন্তু এই দুর্ঘটনার নেপথ্যে যেসব যানবাহনের যোগসাজশ রয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম ব্যাটারিচালিত রিকশা। অবৈধভাবে এবং অবৈজ্ঞানিক এই বাহনকে বারবার সড়ক-মহাসড়ক থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা হলেও, তেমন কোনো সুফল মেলেনি! ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ৩৪ হাজার ৮৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩৭ হাজার ৩৮২ জন নিহত এবং ৫৯ হাজার ৫৯৭ জন আহত হয়েছেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দেওয়া এক পরিসংখ্যানে এসব তথ্য উঠে আসে। সংগঠনটি দাবি জানায়, দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ জনের প্রাণহানি দেশের জন্য একটি জাতীয় সংকট। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, না হলে প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির এই ধারা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

এই যানের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হয় সবচেয়ে বেশি, কারণ চালকরা উল্টোপথে যাচ্ছেতাইভাবে চলাচল করে। শুধু তাই নয়, মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবেশও। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) ব্যাটারি রিকশা ও সিসা দূষণ নিয়ে গবেষণা করেছেন ড. মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ব্যবহৃত হওয়ার পর পুরোনো ব্যাটারিগুলো যথেচ্ছভাবে ফেলে দেওয়া হয়। কখনোবা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ‘পোড়ানোর ফলে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ সিসা ফেরত পাওয়া যায়। বাকি ২০ শতাংশ মাটি, নদী, খাল, বিলসহ পরিবেশে নিক্ষিপ্ত হয়। অর্থাৎ, রিকশাপ্রতি গড়ে ২০ কেজি সিসা হিসাবে ধরলে, ৪০ লাখ বাহনে প্রতিবছর ৮০ কোটি কেজি সিসা যুক্ত হচ্ছে আমাদের পরিবেশে। সিসা ধ্বংস হয় না। সহজে অনুমেয়, আগামী ১০ বছরে সিসা দূষণ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে!’ কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্তই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি!

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে ৫ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলে। আর প্যাডেলচালিত রিকশা রয়েছে ১০ লাখের বেশি। সূত্রটি বলছে, চলতি বছরের (২০২৫) মার্চে রাজধানীর ৩ পয়েন্টে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও প্যাডেলচালিত রিকশা বন্ধে ‘রিকশা ট্র্যাপার’ বসানো হয়। এই পয়েন্টগুলো হলো— কাকরাইল ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের পাশে ব্যাটারি গলি; ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১ নম্বর গেটের সামনে এবং পুরোনো রমনা থানার সামনের সড়কে। আরও কিছু জায়গায় এই ট্র্যাপার বসানো হয়। তবে এই উদ্যোগ কোনো কাজে আসেনি। কারণ ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো এই ট্র্যাপার অনায়াসে পার হয়ে যাচ্ছে। এতে প্রাইভেটকারের টায়ার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আরেকটি সূত্র বলছে, ব্যাটারিচালিত রিকশা সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন, তবে সারাদেশে ৫০ লক্ষাধিক এবং ঢাকায় প্রায় ৮-১০ লাখের মতো সংখ্যা অনুমান করা হচ্ছে, যেখানে বেশিরভাগই অনিবন্ধিত ও অবৈজ্ঞানিকভাবে তৈরি। এই যানগুলোর সংখ্যার সঠিক হিসাব নেই, তবে এদের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে এবং পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। ২০২৪ অনুসারে রাজধানীতে নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা ছিল মাত্র ২ লাখ ১০ হাজার ৭০০টি, যার সবই প্যাডেলচালিত। এর বাইরে থাকা প্রায় সব ব্যাটারিচালিত রিকশা অনিবন্ধিত। পরবর্তীকালে ব্যাটারিচালিত রিকশা অনিয়ন্ত্রিতহারে বেড়ে চলেছে!
ব্যাটারিচালিত রিকশার কাঠামোগত ও যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে, বিশেষ করে ব্রেকগুলো খুব দুর্বল। ফলে দুর্ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। ঢাকাসহ সারাদেশে যেভাবে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার এই যানবাহন ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে করে বারবার প্রশ্ন উঠছে– কেন এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না?

কর্তৃপক্ষের সঠিক সিদ্ধান্তের অভাব এবং সাধারণ মানুষের অসচেতনতা দিন দিন এই যানবাহনকে আরও মরণঘাতী করে তুলছে। ‘অনেকে গরিব মানুষের পেটে লাথি মারা’ নামক সস্তা আবেগ দিয়ে অবৈধ যানবাহনকে সার্টিফাইড করেন! কেউবা এদের পক্ষ নিয়ে যারা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিঞ্চিৎ পদক্ষেপ নিতে চায়, তাদেরও কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন! কিন্তু অবৈধ এই যানের ফলে ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন জেলায় সড়কে বিশৃঙ্খলা বেড়েছে, বাড়ছে। এমনকি হরহামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা। এখনো যদি কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তবে অদূর ভবিষ্যতে জাতির জীবনে আরও দুর্দশা অপেক্ষা করছে! অনিয়ন্ত্রিত এই যানের কারণে রাস্তায় বড় বড় যানবাহন বিপাকে পড়ে। হঠাৎ ব্রেক দেওয়ায় যাত্রীরা আহত হচ্ছে! কখনোবা দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের রিকশায় নারীদের ওড়না আটকে মৃত্যুবরণ করতে! যারা মৃত্যুবরণ করছে তারা চিরতরে চলে যাচ্ছে; কিন্তু যারা জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকছে, তাদের পরিণতি আরও সংকটাপন্ন।

বর্তমানে সড়ক-মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য এতটা বেড়েছে যে, তারা অন্যকে তোয়াক্কাই করে না অধিকাংশ সময়। অতিরিক্ত জ্যামের ভেতর ঢাকা শহরের মতো ব্যস্ত নগরীর ফুটপাতেও এই বাহনের দেখা মেলে! যানবাহনটির ব্রেক সিস্টেম ঠিক না হওয়ায়, পথচারী রাস্তা পার হতে গেলে তাদের সিগনাল দিলেও তারা পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কিন্তু এর ফলে বড় দূর্ঘটনার মুখোমুখি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ২০২৫ সালের ২৫ এপ্রিল বাইকাররা মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের দাবি তোলে, উৎপাদন কারখানা বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও কোনো সুফল মেলেনি। 

ব্যাটারিচালিত রিকশা আমদানি হয় না বাংলাদেশে। এগুলো দেশে তৈরি হয় দেশীয় কারিগরদের হাতে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে; ঢাকার মোহাম্মদপুর, বসিলা, কেরানীগঞ্জ, বেড়িবাঁধ, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, মান্ডা, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায়, মূলত পাড়া-মহল্লাগুলোয় গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য ওয়ার্কশপ। এখান থেকে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে শত শত অটোরিকশা। বছর দুয়েক ধরে রিকশাচালকদের মধ্যে অটোরিকশার চাহিদা বাড়তে থাকলে, ওয়ার্কশপগুলো তৈরি হতে থাকে। এসব অটোরিকশায় পরিশ্রম কম, আয় বেশি। ফলে রিকশাচালক ছাড়াও অন্যান্য পেশার লোকজনও অটোরিকশা চালানো শুরু করে। দেশে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা অবৈধ। ফলে এই অবৈধ যানবাহন যখন পাড়া-মহল্লার রাস্তা পেরিয়ে মূল সড়কে একের পর এক উঠে আসতে শুরু করে তখন এটা নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকে।

এই যানবাহনের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা; কিন্তু দুরন্ত গতি। ফলাফল সড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা। মফস্বল শহরগুলোতে এখন দুর্ঘটনা আর দীর্ঘ যানজটের বড় কারণ অটোরিকশা। প্রধান প্রধান সড়ক তো বটে, এমনকি ফ্লাইওভারের উপরেও অটোরিকশার দেখা মেলে হরহামেশা। সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা ৫০ লাখ। যার সবগুলো তৈরি হয়েছে অবৈজ্ঞানিকভাবে। আর এর প্রতিটি চালকও অবৈধ। নতুন করে যাতে আর তৈরি হতে না পারে, তাই এর উৎস বন্ধের পাশাপাশি সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে বৈজ্ঞানিক উপায়ে এসব বাহন সংস্কারের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তিন চাকার রিকশার সঙ্গে লাগানো হয়েছে ব্যাটারি। যাত্রী তোলা হচ্ছে দুই থেকে চারজন পর্যন্ত। অথচ এই রিকশার নিয়ন্ত্রণে যে ব্রেক লাগানো হয়েছে, তার দাম মাত্র ২২ টাকা। এসব রিকশার গতি যে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তা স্বীকারও করেন এর চালকরা। আগে চীন থেকে এসব ব্যাটারি এলেও, এখন এগুলো তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। কারণ ক্যারিং খরচ বেশি পড়ে যায়। ঢাকার দেড় শতাধিক কারখানায় অবৈজ্ঞানিকভাবে তৈরি করা হচ্ছে এসব ঝুঁকিপূর্ণ রিকশা। যারা এসব রিকশা বানাচ্ছেন, তাদেরও নেই কোনো কারিগরি দক্ষতা। ফলে সড়কে বিশৃঙ্খলা বাড়ার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ, প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এসব রিকশা যারা বানাচ্ছেন আর যারা চালাচ্ছেন, তারা কেউই প্রশিক্ষিত নয়। এসব বাহন যাত্রীদের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ।’ একটি প্রাণ অনেক বেশি মূল্যবান। কোনো কিছুর বিনিময়ে প্রাণকে নিলামে তোলা বোকামি। কিন্তু এদেশের মানুষ আজও যথেষ্ট সচেতন নয়। যার পরিবারে দুর্ঘটনা ঘটছে তারা গুটিকয় বাদে অধিকাংশই রিকশাচালকের দোষ দেখেন না। ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পায়েচালিত রিকশার নিবন্ধন দেওয়ার পাশাপাশি অনিবন্ধিত রিকশা বাতিল করতে হবে। যানবাহনগুলো বৈজ্ঞানিকভিত্তিতে আধুনিকায়ন করতে হবে। যাতে পরিবেশ দূষণ বা যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যেতে পারে। পাশাপাশি বেকারত্ব না বাড়িয়ে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। সবার আগে কঠোর হাতে অবৈধ যান বাজেয়াপ্ত করা এবং মালিক ও চালকদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ব্যাটারিচালিত রিকশার ফলে কী ধরনের ঘটনাগুলো ঘটতে পারে, সে-সম্পর্কে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রামাণ্যচিত্র ও বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাত্রীরা সচেতন হলে এ সমস্যা অনেকটা কমে আসবে। বিষয়গুলোর সমন্বিত বাস্তবায়ন ঘটলে কেবল এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব। এসব গাড়িকে লাইসেন্সের অধীনে আনা, চালকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের ব্যবস্থা করা, মনোনীত চার্জ স্টেশন করা এবং গাড়ি কোথায়, কখন ও কতগুলো চলবে, এজন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে তার ভিত্তিতে আইন করলেও উপর্যুক্ত সমস্যা থেকে পরিত্রাণ ঘটবে। তাই মানুষকে সুন্দর-সুস্থ পৃথিবী উপহার দিতে সময়ের চাহিদাকে অস্বীকার না করে, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

লেখক : গবেষক, প্রভাষক, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি

 

আরও পড়ুন