ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেলে ‘আ. লীগের উত্তরাধিকার পরিকল্পনা’

আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৫৪ পিএম

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসা শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারত থেকে দল পরিচালনা করছেন। বয়স ও রাজনৈতিক বাস্তবতার চাপে এবার তিনি উত্তরাধিকার পরিকল্পনার দিকে মনোযোগী হচ্ছেন বলে দলীয় এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে আলোচনা জোরাল হয়েছে।

কংগ্রেসের ‘রাহুল-প্রিয়াঙ্কা’ মডেলের মতোই শেখ হাসিনা তার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং ভাগ্নে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে সামনে এনে একটি নতুন নেতৃত্ব কাঠামো তৈরি করতে চাইছেন বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।

৪৪ বছরের নেতৃত্ব, অনুপস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা

১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। এরপর টানা চার দশকের বেশি সময় তিনি দলের নেতৃত্বে আছেন। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর দেখা দেয় দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা। কে সিদ্ধান্ত নেবে তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয় তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, উত্তরাধিকার পরিকল্পনার অভাবও সেই সংকটের অন্যতম কারণ।

জয়, পুতুল, ববি নতুন ত্রিমুখী নেতৃত্ব

দলীয় সূত্র ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, শেখ হাসিনা এবার তার পরিবার থেকেই উত্তরসূরি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।

সজীব ওয়াজেদ জয়: শেখ হাসিনার ছেলে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করলেও মায়ের রাজনৈতিক মুখপাত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সক্রিয়।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল: সদ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের দায়িত্ব থেকে ছুটিতে যাওয়া শেখ হাসিনার মেয়ে এখন দিল্লিতে থেকে মায়ের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন।

রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি: শেখ রেহানার ছেলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)-এর সঙ্গে যুক্ত। তাকেও ভবিষ্যতের কণ্ঠস্বর হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে।

সায়মা রাজনীতিতে, WHO থেকে অব্যাহতি

২০২৫ সালের জুলাইয়ে হঠাৎ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সায়মা ওয়াজেদকে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠায়। এর পরপরই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সরকারের আপত্তি, সায়মার কাজে অনাগ্রহ এবং দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের প্রেক্ষাপটে তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় বলে জানা যায়। তার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়াকে পরিবারকেন্দ্রিক উত্তরাধিকার কাঠামোর একটি অংশ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

গান্ধী পরিবার অনুসরণে ‘পরিবারতন্ত্র’

ভারতের কংগ্রেস পার্টির রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর মতো মডেল অনুসরণ করছেন শেখ হাসিনা  এমনই মত বিশ্লেষকদের। ভারতে যেমন সোনিয়া গান্ধীর অনুপস্থিতিতে ছেলে রাহুল নেতৃত্ব দেন, বোন প্রিয়াঙ্কা সহায়কের ভূমিকা রাখেন; ঠিক তেমনই জয়, পুতুল ও ববিকে সামনে আনা হচ্ছে নেতৃত্ব কাঠামোতে।

ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিনোদ শর্মা বলেন, ভারতে কংগ্রেস যেমন পরিবারকেন্দ্রিক, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগও তাই। এখানে নেতৃত্ব পরিবার থেকেই আসবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

দলের অভ্যন্তরে প্রতিক্রিয়া

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আরাফাত বলেন, সাকসেশন প্ল্যান এখন আমাদের অগ্রাধিকার নয়। আমাদের প্রধান লক্ষ্য গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। কে কী পদে আসবেন, সেটা পরে দেখা যাবে।

তবে দলীয় একাধিক সূত্র বলছে, এই ‘সাকসেশন প্ল্যান’ এখন অনেকটাই পর্দার আড়ালে হলেও বাস্তবায়নের দিকেই যাচ্ছে। সায়মা ওয়াজেদ ইতিমধ্যেই নিয়মিত বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন, জয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের ব্যাখ্যা তুলে ধরছেন এবং ববিকেও দলীয় প্রোগ্রামে আরও বেশি দেখা যাচ্ছে।

ওবায়দুল কাদেরদের কোণঠাসা অবস্থান

দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভারতেই অবস্থান করলেও শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়নি প্রায় ১০ মাস। বরং দলীয় সিদ্ধান্তে মুখ্য ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে আ.ফ.ম. বাহাউদ্দিন নাসিম, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও জাহাঙ্গীর কবির নানককে। এর মধ্যে নানকের সঙ্গে সায়মা ওয়াজেদের সরাসরি যোগাযোগের কথাও জানা গেছে।

৭৬ বছরের পুরনো দল আওয়ামী লীগ বর্তমানে ইতিহাসের অন্যতম সংকটময় সময় পার করছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে থাকা সত্ত্বেও বাস্তবতা তাকে উত্তরাধিকার প্রশ্নে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। পরিবারকেন্দ্রিক নেতৃত্ব যে আরও সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তা নানা প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যেই স্পষ্ট। আওয়ামী লীগের পরবর্তী অধ্যায়ে ‘ফার্স্ট ফ্যামিলি’ই কীভাবে নেতৃত্ব দেয় সেই প্রশ্ন এখন রাজনীতির কেন্দ্রে।

DR/AHA
আরও পড়ুন